সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বাড়ছে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলার সংখ্যা

পুলক ঘটক
2017.07.12
ঢাকা
সাংবাদিক গোলাম মুজতবা ধ্রুব’র বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন। সাংবাদিক গোলাম মুজতবা ধ্রুব’র বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন। জুন ১৫, ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

গত ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন জেলায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় অন্তত ২৫টি মামলা হলেও এই আইনটি সাংবাদিকদের জন্য করা হয়নি বলে সংসদে জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।

“বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী আমাদের কাছে গত ছয় মাসে অন্তত ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই ধারায় মামলা হওয়ার তথ্য আছে,” বেনারকে বলেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব ওমর ফারুক।

তবে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এই আইনে সাংবাদিক নিগৃহীত হওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসস জানায়, বুধবার জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমানের এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে তথ্যমন্ত্রী বলেন, “আইনটা সাংবাদিকদের জন্য করা হয়নি। ডিজিটাল এবং নাগরিক নিরাপত্তার জন্য করা হয়েছে।”
বাংলাদেশে ২হাজার ৮০০র বেশি পত্রপত্রিকা এবং এক হাজার ৮০০টির বেশি অনলাইন পোর্টাল রয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “দেশে সাংবাদিকের সংখ্যার তুলনায় এই আইনের ৫৭ ধারায় খুবই নগণ্য সংখ্যক সাংবাদিক গ্রেপ্তার হয়েছেন।”

“এ আইনটা মানবাধিকার বিরোধী বলে আমি মনে করি না”, সংসদে বলেন তথ্যমন্ত্রী।

কয়েকটি উদাহরণ

গত রবিবার দৈনিক প্রথম আলোর হাজীগঞ্জ (চাঁদপুর) উপজেলা প্রতিনিধি মোহাম্মদ শাহজাহান এবং মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হায়দার চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ওই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গত ২২ মে আরও একটি মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল।

মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম সংক্রান্ত একটি রিপোর্টের কারণে স্থানীয় সংসদ সদস্য মেজর (অব.) রফিকুল ইসলামের মানহানি হয়েছে এই অভিযোগ এনে সংসদ সদস্যের দুজন সমর্থক মামলা দুটি দায়ের করেন।

এ রকম অপর একটি মামলায় মঙ্গলবার হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন দৈনিক সকালের খবরের সাংবাদিক আজমল হক হেলাল। সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী সম্পর্কে প্রকাশিত একটি সংবাদ ফেসবুকে শেয়ার করার দায়ে শুক্রবার পিরোজপুর তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।

গত কয়েক দিনে সমকাল পত্রিকার চট্টগ্রাম ব্যুরোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক তৌফিকুল ইসলাম, যমুনা টেলিভিশনের সাংবাদিক নাজমুল হোসেন, বিডিনিউজ ২৪ এর গোলাম মুস্তবা ধ্রুব, বিজয় নিউজটোয়েন্টিফোর ডটকম এর সম্পাদক শামসুল আলম স্বপনসহ কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই ধারায় মামলা হয়েছে।

“এসব মামলায় সাংবাদিকদের যেন অযথা হয়রানি করা না হয় এবং সতর্কতার সঙ্গে তদন্ত করা হয় সে জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে,” বেনারকে জানিয়েছেন মহাপুলিশ পরিদর্শক একেএম শহিদুল হক।

আইন নিয়ে আপত্তি

২০০৬ সালে তথ্য প্রযুক্তি আইন প্রণয়নের পর জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার দায়ে ২০১৩ সালের এপ্রিলে চারজন ব্লগারকে ৫৭ ধারায় গ্রেপ্তার করার পর থেকে আইন বাতিলের দাবিতে সরব হয়ে ওঠেন অনলাইন লেখকেরা।

২০১৫ সালে সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের ও তাঁকে গ্রেপ্তারের পর ৫৭ ধারা বিষয়ে সাংবাদিকেরা মুখ খুলতে শুরু করেন।

“৫৭ ধারার ব্যাপারে শুরু থেকেই আমাদের আপত্তি আছে এবং এই আইন বিলুপ্ত করার দাবিতে গণমাধ্যম কর্মীরা আন্দোলন করে আসছে,” বেনারকে বলেন দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সিনিয়র সহসভাপতি সাইফুল আলম।

এদিকে রবিবার বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীরা এবং মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটি ৫৭ ধারা বাতিলসহ অন্যান্য দাবিতে সমাবেশ করেছে।

ট্রাইব্যুনালে মামলার সংখ্যা বাড়ছে

সাইবার সিকিউরিটি ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নজরুল ইসলাম শামীম বেনারকে বলেছেন, “তথ্যপ্রযুক্তি আইনে এ পর্যন্ত দায়ের হওয়া ৭৪০টি মামলা ট্রাইব্যুনালে এসেছে। দেশের যে কোনো প্রান্তে মামলা হলে সেই মামলাগুলো নিষ্পত্তির জন্য এই আদালতে পাঠানো হয়।”

“এসব মামলার ৬০ শতাংশই ৫৭ ধারার। ২০০৬ সালে প্রণীত এই আইনে ২০১৩ সালে প্রথম ৩টি মামলা দায়ের হয়। এর পর থেকে প্রতি বছর মামলার সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ২০১৪ সালে এই আইনে মামলা হয়েছে ৩৩টি, ২০১৫ সালে ১৫২টি, ২০১৬ সালে ২৩৩টি এবং এ বছর জুলাই পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৩১৯টি,” পিপি জানান।

নতুন আইনেও আপত্তি

তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিলেও প্রায় একই আদলে নতুন একটি আইন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। আগামী আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময় এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যাবে বলে রবিবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

‘সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা’ শীর্ষক প্রস্তাবিত এই আইনেও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করা হচ্ছে।

প্রস্তাবিত আইনের ১৯ ও ২০ ধারায় অপরাধের সাজা কমিয়ে ৫৭ ধারার বিষয়বস্তুই রাখা হয়েছে। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছর ও সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদণ্ডের বিধান আছে।

প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৯ ধারায় একই ধরনের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ দুই বছর ও সর্বনিম্ন দুই মাসের কারাদণ্ড এবং ২০ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড এবং নিম্ন এক বছরের কারাদণ্ড প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত আইনের ১৯ ধারায় ‘কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার’ মতো কোনো কিছু ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশ করলে তিন বছর কারাদণ্ডের বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বেনারকে বলেছেন, “আইন যখন অনুভূতি বা ভাবমূর্তির ব্যাপার হয় তখন তা পরিমাপ করা যায় না। ফলে তা অপব্যবহারের সুযোগ থাকে।”

তিনি বলেছেন, “কারও অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া, খুশি করা এগুলো ফৌজদারি আইনের ব্যাপার না। কারণ এগুলো নিরূপণ করা যায় না।”

“আমরা মনে করি আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বা এই ধারার আদলে নতুন কোনো ধারা মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য বড় অন্তরায়,” বেনারকে বলেন ওমর ফারুক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।