ইউরোপ থেকে অবৈধ বাংলাদেশি ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত

জেসমিন পাপড়ি
2017.08.30
ঢাকা
এসওপির বিষয় চূড়ান্ত হওয়ার পর স্বাক্ষর করছেন বাংলাদেশ-ইইউ প্রতিনিধরা। এসওপির বিষয় চূড়ান্ত হওয়ার পর স্বাক্ষর করছেন বাংলাদেশ-ইইউ প্রতিনিধরা। ৩০ আগস্ট ২০১৭।
সৌজন্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

অবশেষে ইউরোপে অবৈধভাবে অবস্থান করা বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) চূড়ান্ত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তাঁরা জানান, আগামী অক্টোবরের মধ্যে এটি সই করবে বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এরপরেই ফেরত আনার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হবে।

তবে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীরা এ সংক্রান্ত মামলা শেষ হওয়া পর্যন্ত সময় পাবেন বলে দুই পক্ষ একমত হয়েছে বলে জানা গেছে।

বুধবার রাজধানী ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন মেঘনায় দু’পক্ষের মধ্যে এই চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্তের কথা নিশ্চিত করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইউরোপ (পশ্চিম) অনুবিভাগের মহাপরিচালক খোরশেদ খাস্তগীর।

তিনি বেনারকে বলেন, “দীর্ঘ আলোচনার পরে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর (এসওপি) চূড়ান্ত করেছি আমরা। এরপর দুই পক্ষ অভ্যন্তরীণ অনুমতি প্রক্রিয়া শুরু করবে। আগামী দুই মাসের মধ্যে এটা স্বাক্ষর হবে বলে আশা করা যায়।”

কবে থেকে অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের ফেরত আনা শুরু হবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এসওপি স্বাক্ষর হওয়ার পরপরই ওই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে।”

তবে হঠাৎ করেই বাংলাদেশিদের ওপর এতটা নিষ্ঠুর হয়ে উঠার কারণ জানতেই চাইলে গত সপ্তাহে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদুন সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা মোটেই নিষ্ঠুর আচরণ করছি না। বরং বৈধভাবে বসবাসে ইইউ বাংলাদেশিদের জন্য সবসময় উন্মুক্ত।”

ঢাকায় শুরু হওয়া দুইদিনব্যাপী বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (দ্বিপক্ষীয়) কামরুল আহসান ও ইউরোপিয়ান কমিশনের এশিয়া প্যাসিফিক বিভাগের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর পলা পামপোলানি। মঙ্গলবার চার সদস্যের ইইউ প্রতিনিধি দলটি ঢাকায় পৌঁছায়। ৩১ আগস্ট তাঁদের ঢাকা ছাড়ার কথা রয়েছে।

তবে বৈঠক শেষে ইউরোপীয় প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমেকে কোন বক্তব্য দেওয়া হয়নি।

বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ, পাসপোর্ট অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা, ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স,আইন, সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষসহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার ধরন জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে জানান, “আমার দেশের নাগরিক ফেরত আনতে হলে তার পরিচয় আগে নিশ্চিত হতে হবে। অর্থাৎ নাগরিকত্ব যাচাই এখানে মুখ্য বিষয়।”

ওই কর্মকর্তা বলেন, “বহু রোহিঙ্গা ইউরোপের দেশগুলোতে অবস্থান করছে। এই সুযোগে তারা যেন কোনোভাবেই বাংলাদেশে আসতে না পারে সে বিষয়টি নিয়েও আমরা সতর্ক। তাই নিয়মমাফিক উপায়ে বাংলাদেশি যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চেয়েছি আমরা।”

তিনি জানান, “পুরো প্রক্রিয়াটির সঙ্গে একাধিক মন্ত্রণালয় জড়িত। সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সমন্বয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠনের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। পাশাপাশি নাগরিকত্ব যাচাই-বাছাইয়ের জন্য নির্বাচন কমিশনের ডেটাবেস, পাসপোর্ট অফিস, ইমিগ্রেশন অফিসের প্রতিনিধিদের নিয়ে বিশেষ সেল গঠনেরও বিষয়ও এসওপিতে রয়েছে।

এ প্রক্রিয়ায় অভিবাসীদের অধিকার ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কা করছেন অভিবাসন বিশেজ্ঞরা।

ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব দ্য রাইটস অব বাংলাদেশি মাইগ্র্যান্টসের (ওয়ারবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক বেনারকে জানান, “২০১৬ সাল থেকে বিশ্বের সকল দেশের অবৈধ অভিবাসীদের বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে একটি ফ্রেমওয়ার্ক গঠনের আলোচনা চলছে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে যেটি চূড়ান্ত হবে। তার আগেই ইউরোপীয় কমিশনের চাপের মুখে বাংলাদেশ এই চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছে।”

অংশীজনদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই সরকার এই চুক্তি করেছে বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “ভাগ্য বদলের উদ্দেশ্য নিয়ে এসব বাংলাদেশি ইউরোপে গেছে। তারা ফিরতে চায় কিনা সে বিষয়টি ভাবা হয়নি।”

কোনো অভিবাসীকে যেন জোর করে অমানবিকভাবে দেশে ফেরত পাঠানো না হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করার দাবি জানান সাইফুল হক। একইসঙ্গে এবং যারা ফেরত আসবেন তাঁদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করার দাবিও জানান তিনি।

প্রসঙ্গত, সর্বশেষ ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান দপ্তর ইউরো স্টেটের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সাত বছরে ইউরোপের দেশগুলোতে ৯৩ হাজার ৪শ ৩৫ জন বাংলাদেশি অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তাদের ফেরত আনতে চাপ দেওয়া হচ্ছিল।

এমনকি গত ২৫ জুলাই বাংলাদেশিদের ভিসার ওপর কড়াকড়ি আরোপের হুমকিও দেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জঁ ক্লদ জাঙ্কার।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, ইউরোপীয় কমিশনের পক্ষ থেকে গত বছর এসওপির একটি খসড়া বাংলাদেশকে দেওয়া হয়েছিল। সেটি যাচাই-বাছাই করে বাংলাদেশ নিজেদের মতামত জানায়। এবার দুপক্ষ এক টেবিলে বসেই সেটি চূড়ান্ত করেছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান ভিত্তিক অধিদফতর ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করা বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭ তম।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে ২০০৮ সালে ৭ হাজার ৮৫ জন, পরের বছর ৮ হাজার ৮শ ৭০ জন, ২০১০ সালে ৯ হাজার ৭শ ৭৫ জন, ২০১১ সালে ১১ হাজার ২শ ৬০ জন, ২০১২ সালে ১৫ হাজার ৩শ ৬০ জন, ২০১৩ সালে ৯ হাজার ৪শ ৯০ জন, ২০১৪ সালে ১০ হাজার ১শ ৩৫ জন এবং ২০১৫ সালে ২১ হাজার ৪শ ৬০ জন বাংলাদেশি প্রবেশ করে।

এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬ সালে প্রায় ৮ হাজার ২শ জন এবং ২০১৭ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত ৮ হাজার ৫ শ’র বেশি বাংলাদেশি ইতালিতে অবৈধভাবে প্রবেশ করে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র।

বৈঠকে অংশ নেওয়া কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা যায়, প্রায় ১৭ হাজার ৩শ বাংলাদেশি ২০১৬ সাল পর্যন্ত ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। যার মধ্যে প্রায় ১১ হাজার ৮শ আবেদন খারিজ হয়েছে। বাকি আবেদনগুলোর বেশিরভাই খারিজের আশঙ্কা রয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক খোরশেদ খাস্তগীর বলেন, “নাগরিকত্ব যাচাই-বাছাইসহ সকল প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের ফেরত আনা হবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীরা এ সংক্রান্ত মামলা শেষ হওয়া পর্যন্ত সময় পাবেন।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।