চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে আবারও প্রাণহানি

জেসমিন পাপড়ি
2017.07.21
ঢাকা
স্থানীয়দের সহায়তায় নিহতদের লাশ উদ্ধার করছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। স্থানীয়দের সহায়তায় নিহতদের লাশ উদ্ধার করছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। জুলাই ২১, ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকা চট্টগ্রামে ভারী বৃষ্টির পর আবারও পাহাড়ধসে একই পরিবারের তিন শিশুসহ অন্তত পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।

বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে সীতাকুণ্ড উপজেলার জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম ভূইয়া।

মাত্র এক মাস আগে পার্বত্য এলাকার পাঁচ জেলায় পাহাড়ধসে সেনা কর্মকর্তাসহ প্রায় দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। সেই শোক না কাটতেই আবারও প্রাণহানির ঘটনাকে কর্তৃপক্ষের অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে দেখছেন পরিবেশবাদীরা। অবিলম্বে দোষীদের বিচার দাবি করেন তাঁরা।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের বেনারকে বলেন, “মাত্র এক মাস আগে অতগুলো মানুষের মৃত্যুর পরেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি। তাঁরা এসব মানুষকে পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাস করতে দিয়েছে। যারা বসবাস করছেন নিঃসন্দেহে তাঁরাও দায়ী হলেও কর্তৃপক্ষের অপরাধ অমার্জনীয়।”

তিনি বলেন, “আইন অমান্য করে বসবাস করতে দেওয়ার দায় সরকার এড়াতে পারে না। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আমরা এখনই বুঝতে পারছি। সামনে অতিবৃষ্টি আরও বাড়বে। এমন অবস্থায় মানুষের জানমালের রক্ষার দায়িত্ব সরকারের।”

সংশ্লিষ্ট যেসকল কর্মকর্তা এই দায়িত্ব পালন করেননি, তাদের বিরুদ্ধে অচিরেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মত দেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম বেনারকে বলেন, “সম্প্রতি ভয়াবহ পাহাড়ধসের ঘটনার পরেও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এই ঘটনা সেটাই প্রমাণ করে। এর ফল হিসেবে ভবিষ্যতে আরও বড় বড় পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটতে পারে।”

ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (ট্রেনিং) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “পাহাড়টি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। ঝুঁকিপূর্ণ এই খাড়া ঢালে টিনের ঘর বানিয়ে বসবাস করছিল পরিবারটি। পাহাড়ধসে নামা মাটি সরাসরি ঘরের ওপর পড়েছিল।”

সরকারি জায়গায় অবৈধভাবে এই ঝূঁকিপূর্ণ বসতি গড়ে উঠেছে স্বীকার করে জেলা প্রশাসক মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী বলেন, “শুধু প্রশাসনের পক্ষে এই বসতি উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে।”

বৃহস্পতিবারের ধসে নিহতরা হলেন; স্থানীয় অটো রিকশা চালক রফিকুল ইসলামের স্ত্রী ফাতেমা বেগম (৩০), ছেলে ইউনুস (১০), বোন রাবেয়া আক্তার (২৫), রাবেয়ার দুই সন্তান সামিয়া (৭) ও লামিয়া (২)। ফাতেমা গার্মেন্টস কর্মী ছিলেন। রাবেয়া দুই সন্তানকে নিয়ে কয়েকমাস আগে ভাইয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসেন।

পাহাড়ধসের পর স্থানীয় লোকজনের সাহায্যে রফিক, তাঁর ভাই গিয়াস উদ্দিন ও দুই মেয়ে জান্নাত ও সালমা বের হয়ে আসতে সক্ষম হন।

নোয়াখালীর বাসিন্দা রফিক আড়াই বছর আগে পাহাড় কেটে সীতাকুণ্ডের সলিমপুর ইউনিয়নের বিরি হাটের এই এলাকায় ঘর তৈরি করে বসবাস শুরু করেন। তাঁর মতো অনেকেই এই পাহাড়ি খাস জমিতে বসতি গড়ে তুলেছে।

স্থানীয়রা জানান, বিভিন্ন পোশাক কারখানার কর্মীসহ দরিদ্র লোকজনই এখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করেন। এই এলাকায় আরও অন্তত ১২০টি পরিবার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানান চট্টগ্রাম মহানগরী ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান।

তবে তাঁর দাবি, “পাহাড়টি ঝুঁকিপূর্ণ বলে অতিরিক্ত বৃষ্টি দেখে রফিককে সতর্ক করেছিলাম। তারপরেও তিনি পরিবার নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাননি।”

প্রসঙ্গত, সাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে বুধবার রাত থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ভারী বর্ষণ শুরু হয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সীতাকুণ্ডে ৩৭৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এর আগে গত ১১ জুন রাঙ্গামাটিতে বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয় ৩৬৫ মিলিমিটার। সেই বৃষ্টিপাতে রাঙ্গামাটিসহ চট্টগ্রাম বিভাগের পাঁচ জেলায় পাহাড়ধসে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এখনো সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত বহাল রয়েছে।

পাহাড়ের ঢালে এই বাড়িতেই বসবাস করছিল নিহতদের পরিবার। জুলাই ২১, ২০১৭।
পাহাড়ের ঢালে এই বাড়িতেই বসবাস করছিল নিহতদের পরিবার। জুলাই ২১, ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

বনভূমি রক্ষার তাগিদ

এদিকে পাহাড়ধস ঠেকাতে পাহাড়গুলোকে সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণা করার পাশাপাশি পার্বত্য এলাকাগুলোতে পাহাড় ও বনভূমি ধ্বংস বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা।

শুক্রবার রাজধানীতে ভূমিধস: কারণ, ফলাফল এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক এক সেমিনারে এমন সুপারিশ আসে।

অনুষ্ঠানে বেসামরিক ও বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের কোণঠাসা করতে সমতলের দরিদ্র আদিবাসীদের নিয়ে সেখানে রাখা হয়। এতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবন ধ্বংসের পাশাপাশি পাহাড়ের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। তাই পাহাড়ধস থামাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন।

সাংবাদিক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদও পাহাড়ধসের পেছনে নষ্ট রাজনীতিকে দায়ী করেন। দেশের সবগুলো পাহাড়কে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে সংরক্ষণ করতে শিগগিরই পাহাড় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ গঠনের দাবি জানান তিনি।

অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত প্রবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড, মো. শহিদুল ইসলাম জানান, সরকারি নীতি নির্ধারণে পাহাড়ধসের গুরুত্ব নেই। সরকারের দুর্যোগ বিষয়ক স্থায়ী আদেশে ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা শব্দ দুটি যথাক্রমে ৩৭৬ ও ২২৯ বার থাকলেও পাহাড়ধস রয়েছে মাত্র তিন বার। অথচ সংরক্ষিত রেকর্ড অনুযায়ী ১৯৬৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত পাহাড়ধসে ৪৪৮ জন মারা গেছেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশে চীন দূতাবাস ও বাংলাদেশ চীনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি যৌথভাবে সেমিনারটি আয়োজন করে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।