সরকারের চাপের মুখে জামায়াত, একের পর এক নেতাদের গ্রেপ্তার

জেসমিন পাপড়ি
2017.10.10
ঢাকা
গ্রেপ্তার হওয়া জামায়াত নেতাদের ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কোর্টে হাজির করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়া জামায়াত নেতাদের ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কোর্টে হাজির করা হয়। অক্টোবর ১০, ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে একের পর এক বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেপ্তার করার অভিযোগ উঠেছে সরকারের বিরুদ্ধে। বিএনপি–জামায়াতের নেতৃত্বাধীন সরকারবিরোধী ২০ দলীয় জোটের নেতা–কর্মীরাই এর শিকার হচ্ছেন। গত দুই সপ্তাহে জামায়াতের ২১ নেতা-কর্মী আটক হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

একদিকে জামায়াত নেতাদের গ্রেপ্তার, অন্যদিকে খালেদা জিয়ার দেশে ফেরার আগেভাগে তিনিসহ দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিষয়গুলো বিরোধীদের চাপে রাখার কৌশল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।

সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার ২০ দলীয় জোটের দুই শরীক দলের দুই শীর্ষ নেতাকে আটক করেছে পুলিশ। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে থেকে বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরানকে এবং রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড় থেকে এনডিপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মঞ্জুর হোসেন ঈশাকে আটক করা হয়।

এর আগে গত সোমবার ঢাকার উত্তরা এলাকা থেকে জামায়াতের আমির ও সেক্রেটারি জেনারেলসহ নয় শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দলটির শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই এখন জেলে অথবা পলাতক রয়েছেন।

সাংগঠনিক বৈঠক চলাকালে গত মাসে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ আটজন, এর আগে দলীয় সাতজন চিকিৎসক নেতাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করার পর কর্মসূচি কমিয়ে দেওয়া হয়।

সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঝিনাইদহ, রংপুর, রাজশাহী ও চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী এবং সমর্থকেরাও গ্রেপ্তার হয়েছেন।

জামায়াতের হরতাল আহ্বান

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মঙ্গলবারই জামায়াত দলের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মুজিবুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত আমির ও সহকারী সেক্রেটারি এ টি এম মাসুমকে ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি নিযুক্ত করেছে। গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দলের গঠনতন্ত্র মোতাবেক এ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নবনিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত আমির মুজিবুর রহমান গতকাল এক বিবৃতিতে গ্রেপ্তার নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রত্যেককে ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার প্রতিবাদে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তা হলো বুধবার সারা দেশে বিক্ষোভ, কাল বৃহস্পতিবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল, আগামী শুক্রবার গ্রেপ্তার নেতাদের মুক্তির জন্য দোয়া।

চাপের মুখে জামায়াত

উচ্চ আদালতের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা হয়েছে। তবে গোপনে জামায়াতের সাংগঠনিক কাজ পুরোপুরি চলছে। এর মধ্যেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে ভেতরে-ভেতরে।

২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতকে ৩৫টি আসন ছেড়েছিল বিএনপি। চারটি আসনে দুই দলই প্রার্থী দিয়েছিল। সব মিলিয়ে জামায়াতের প্রার্থীরা মাত্র দুটি আসনে জিততে পেরেছিলেন।

ওই নির্বাচনে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ শীর্ষস্থানীয় নেতারা প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন।

ইতিমধ্যে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে নিজামী, মুজাহিদসহ দলের পাঁচ শীর্ষস্থানীয় নেতার ফাঁসি হয়েছে। একই অপরাধে দণ্ডিত অবস্থায় কারাগারে মারা গেছেন সাবেক আমির গোলাম আযম ও নায়েবে আমির আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ।

আরও তিন নেতা দণ্ডিত হয়ে কারাগারে আছেন। তাঁরা হলেন সাবেক নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আবদুস সুবহান ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম।

হঠাৎ করে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের হিড়িককে সরকারের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দিন আহমদ এ প্রসঙ্গে বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারের চরম ব্যর্থতা ও প্রধান বিচারপতির উপর থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে সরকার পরিকল্পিতভাবে এখন বিরোধী মতের দলগুলোর নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করছে।”

খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা ও আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলকে আরও কোনঠাসা করতে সরকার গ্রেফতার-আটকের কৌশল নিয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য ‌ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক মনে করেন, “কোনো রাজনৈতিক দল গোপন বৈঠক করে ষড়যন্ত্র করলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নিয়ম মতো ব্যবস্থা নেবে। এটা প্রত্যাশিত।”

ষড়যন্ত্র দেখছে না আওয়ামী লীগ

সরকার নয়, আদালতই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে উল্লেখ এখানে সরকারের ষড়যন্ত্রের কিছু নেই বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

মঙ্গলবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

তাঁর প্রশ্ন, “বিএনপির চেয়ারপারসন ও নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কি সরকারের গ্রেফতারি পরোয়ানা না আদালতের?

রিমান্ডে জামায়াত নেতারা

এদিকে গোপন বৈঠকে গ্রেপ্তার জামায়াতের আমির মকবুল আহমাদ ও সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানসহ ৮ শীর্ষ নেতার প্রত্যেককে ৫দিন করে মোট ১০দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।

বিস্ফোরক ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের দুটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে মঙ্গলবার বিকেলে তাঁদের আদালতে হাজির করে মামলার তদন্তের জন্য প্রত্যেকের ১০দিন করে মোট ২০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন কদমতলী থানার পরিদর্শক সাজু মিয়া। রিমান্ড শুনানি শেষে এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. গোলাম নবী।

গ্রেপ্তার হওয়া অন্যান্য নেতারা হলেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরওয়ার, চট্টগ্রাম মহানগরের আমির মোহাম্মদ শাজাহান ও সেক্রেটারি নজরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার আমির জাফর সাদেক, সেক্রেটারি জেনারেলের ব্যক্তিগত সহকারী নজরুল ইসলাম ও সাইফুল ইসলাম।

জামায়াত নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে এবং নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে মঙ্গলবার রাজধানীতে বিক্ষোভ করেছে মহানগর জামায়াত। এ সময় পুলিশ দলটির ছয়জন কর্মীকে আটক করেছে।

বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের সেক্রেটারি ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিমের নেতৃত্বে উত্তর বাড্ডা এলাকায় সংক্ষিপ্ত বিক্ষোভ সমাবেশ করে দলটি। সমাবেশ শেষে পুলিশ সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ৬ জনকে আটক করে বলে অভিযোগ করেন রেজাউল করিম।

সমাবেশে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে সরকার এখন দমন-পীড়নের পথ বেছে নিয়েছে।”

কেন্দ্রীয় নেতাদের মুক্তির দাবিতে দক্ষিণ ঢাকায়ও এক সংক্ষিপ্ত বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে জামায়াতে ইসলামী।

বিএনপি’র বিক্ষোভ বুধবার

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির প্রতিবাদে আগামীকাল বুধবার সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি। সোমবার এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

চোখে অস্ত্রোপচার হওয়ায় খালেদা জিয়া লন্ডনে চিকিৎসাধীন জানিয়ে তিনি বলেন, “বিএনপি চেয়ারপারসনের দেশে ফেরার সময় যখন আসন্ন, তখনই তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ঘটনা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও প্রতিহিংসামূলক।”

সংবাদ সম্মেলনে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।

প্রসঙ্গত, বাসে পেট্রলবোমা মেরে আটজনকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দলটির ৭৮ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে সোমবার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে কুমিল্লার একটি আদালত।

রিজভী বলেন, “মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির প্রতিবাদে আগামী বুধবার ঢাকা মহানগরসহ দেশব্যাপী বিক্ষোভ সমাবেশ করবে বিএনপি।”

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার প্রতিবাদে রাজধানীতে বিক্ষোভ করেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।

এদিকে মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর দৈনিক বাংলা ও পল্টন এলাকায় বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করার সময় ছাত্রদলের ৮ নেতাকে আটক করার অভিযোগ করেছেন ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান।

এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে পল্টন থানার ওসি (অপারেশন) সিদ্দিকুর রহমান বেনারকে বলেন, “পল্টন থেকে কয়েক জনকে আটক করা হয়েছে। মতিঝিল থানায়ও দুজনকে আটক রয়েছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।