বাংলাদেশে আইএস’র নামে হত্যা চলছে

রোহান গুণারত্না, মন্তব্য প্রতিবেদন
2015.10.20
BD-isis অজানা জঙ্গিদের হাতে নিহত ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেল্লার মরদেহ ইতালীতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
এএফপি

কথিত ইসলামিক স্টেটের নেতাদের আহ্বানে হত্যার যে ঘটনা চলছে তা শুরু হয়েছে মূল সংঘাতভূমি থেকে অনেক দূরে।

আইএস’র বিরুদ্ধে লড়াই-এ যোগ দেয়া জোটের নাগরিকদের হত্যার হুমকি দেবার পর আইএস’র অফিসিয়াল মিডিয়া থেকে দাবি করা হয় বাংলাদেশে সম্প্রতি ইটালীয় ও জাপানী নাগরিকদের তারা হত্যা করেছে।

এই দুই হত্যার মূলহোতা ও জড়িতদের প্রকৃত পরিচয় নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এই হত্যায় আইএস জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে বলছে দেশের স্থিতিশীলতা বিপন্ন করার ষড়যন্ত্র হিসেবে দেশীয় জঙ্গিরা এসব করছে, তাদের মধ্যে ইসলামি ছাত্র শিবিরও অন্তর্ভূক্ত।

আইএস’র হুমকি বাতিল করার পরিবর্তে প্রয়োজন ঘটনার গভীরে গিয়ে তদন্ত ও গবেষণা করা এবং অবস্থা আরও খারাপ হবার আগে ব্যবস্থা গ্রহন করা। একে উপেক্ষা করা হলে দেশের বিনিয়োগ, প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হতে পারে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাস বিরোধী লড়াই-এ কঠোর মনোভাব নিয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁকে গুরুত্ব দিতে হবে যে দেশে আইএস ধীরে ধীরে আল-কায়দার অবস্থান নিয়ে ক্রমাগত প্রভাব বিস্তার শুরু করেছে। যিনি নিজে একজন সন্ত্রাসবাদের শিকার। তাঁকে ২০১৪ থেকে শুরু হওয়া এই অঞ্চলে আইএসের প্রচার-প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে লড়াইতেও নেতৃত্ব দিতে হবে।


আইএস’র দাবি

সিজার তাভেল্লা, ৫০, নেদারল্যান্ড-ভিত্তিক একটি এনজিওর কর্মি হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করছিলেন। গত ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় মটর সাইকেল আরোহী কয়েকজনের গুলিতে নিহত হন। জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি, ৬৬, একজন কৃষি ফার্মের মালিক গত ৩ অক্টোবর রংপুরে একইভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।

সাইট ইন্টেলিজেন্ট-এর ভাষ্যমতে, তাভেল্লা নিহত হবার পর আইএস তাদের ২৮ সেপ্টেম্বরের বার্তায় জানায়, “ ইটালীয় বিদেশী ক্রুসেডার বাংলাদেশের খেলাফতের সৈনিকদের হাতে নির্মূল হয়েছেন”।

বার্তায় আরো বলা হয়, “আমরা ক্রুসেডার জোটের নাগরিকদের বলছি তোমরা কেউ মুসলমানদের ভূমিতে নিরাপদ থাকবে না এবং এটা কেবল বৃষ্টির প্রথম ফোটা”।

এই আক্রমনের খবর আত্তাকিমও তার ব্লগে বাংলায় প্রকাশ করেছে। আইএস’র ইংরেজি সংস্করণ তাদের আল-বায়ন প্রাদেশিক খবরের বুলেটিনে এই ইটালীয় হত্যার দায় স্বীকার করে ২৯ সেপ্টেম্বর।

তাভেল্লা হত্যার ৫ দিন পর ৩ অক্টোবর জাপানি নাগরিক হোশিকে রংপুরে হত্যা করা হয়। আইএস একই ভাষায় তাকেও হত্যার দায় স্বীকার করে। যা একইদিন টুইটারে ছড়িয়ে দেয়া হয়।

বার্তায় আরো বলা হয়, “ক্রুসেডার জোটভুক্ত দেশ গুলোর নাগরিকদের বিরুদ্ধে সিরিজ আক্রমন অব্যাহত থাকবে, মুসলমানদের ভূমিতে তাদের নিরাপত্তা কিংবা জীবিকা থাকবে না”।


বাংলাব্লগের দাবি প্রসঙ্গে

সাইট ইন্টেলিজেন্ট গ্রুপের ডাইরেক্টর রিতা কাতস অনলাইনে ছিলেন যখন দুই হত্যার দায় স্বীকার করে আইএস টুইটারে তাদের একাউন্টে বার্তা দেয়। তাভেল্লা হত্যার দায় স্বীকার করা হয় ২৮ সেপ্টেম্বর বেলা ১.২০ মিনিটে ইস্টার্ন টাইমে আর জাপানি হত্যার দাবি করে টুইটার পোস্ট করা হয় ৩ অক্টোবর সকাল ১১.২০ মিনিটে ইস্টার্ন টাইমে, জানায় কাতস।

বাংলাদেশের কর্মকর্তারা জানান, এই হত্যাকান্ডের দাবি সম্বলিত বিবৃতিটি একটি বাংলা ব্লগে দেয়া হয়, “ কয়েকজন বাংলাদেশি পরিচালিত একটি সাব-ডোমেইনে”। ঢাকা হত্যাকান্ডের ৫ ঘন্টা পর এবং রংপুর হত্যাকান্ডের পর ৪ অক্টোবর মধ্যরাতের কিছুক্ষন পর।
তবে, সাইটের তদন্তে দেখা যায়, হত্যার দাবি প্রথম প্রকাশিত হয় আইএস’র অফিসিয়াল টুইটার একাউন্টে।

রিটা কাতস জানায়, ভিন্নভাবে প্রকাশের জন্য “২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে এই বাংলা ব্লগটি গুগলের ব্লগ প্লাটফর্ম ব্লগস্পট ডটকম থেকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেখানে আইসিসের পোস্টিংগুলো বাংলায় অনুবাদ করে দেয়া হচ্ছে, এই বার্তাগুলো আইসিসের অফিসিয়াল মিডিয়া থেকে কপি করে বাংলা কমিউনিটিতে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এবং সেখান থেকে লোকজন নিয়োগের জন্য”।

তিনি আরো জানান, “ দুই হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করা আইসিসের টুইটার বার্তা প্রকাশ করা হয়  তাদের বাংলা ব্লগ পোস্টের অন্তত ১২ ঘন্টা আগে। বাস্তব হচ্ছে, আইসিস অফিসিয়ালি তাদের আক্রমনের দায় স্বীকার করে থাকে তাদের কৃতিত্ব প্রকাশের জন্য। সেটার বিরুদ্ধে যুক্তি প্রদর্শন বা সেটাকে বাতিল করার পরিবর্তে বাংলাদেশি পুলিশের পুরোপুরি মেনে নেয়া উচিত”।  

তিনি জানান আরো, “আমরা যতদিন ধরে আইসিসকে ট্র্যাক করছি, তদের আক্রমনের কোনো দাবি ভুল প্রমাণ হয়নি, তাই গুরুত্বপূর্ণ হলো কর্তৃপক্ষের আরো তদন্ত চালানো”।


ভবিষ্যত হুমকি

সন্ত্রাসীদের হুমকি অনলাইন ও অফলাইন উভয় ক্ষেত্রে চলছে। আইসিসের খেলাফত ঘোষণার পর থেকেই সোশাল মিডিয়ায় বাংলায় তাদের তথ্য ও বিবৃতি প্রকাশিত হচ্ছে। সংখ্যায় কম সংখ্যক বাংলাদেশ থেকে সিরিয়ার আইএস-এ যোগ দিচ্ছে, কিন্তু আইএসের সমর্থক ইউরোপে বাংলাদেশি প্রবাসীদের মধ্যে বেড়ে চলেছে।

যেমন আফাগানিস্থানের যুদ্ধে অনেকে অংশ নিয়েছিল, তাদের কেউ কেউ এবং তরুনদের মধ্য থেকে কিছু সিরিয়ায় যাচ্ছে।

২১ বছরের আসেকুর রহমান ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে  তুরস্কে একটি কনফারেন্সে যোগ দিতে যায়, তার ফেরার কথা ছিল ২৭ ফেব্রুয়ারি। সে ফিরে আসেনি বরং তুরস্ক থেকে আইএস-এ যোগ দিতে সিরিয়ায় চলে যায়। আসেকুর সেনাবাহিনী পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় মিলিটারি ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে পড়াশুনা করতো।

আইএস মিডিয়া চাচ্ছে, বাংলাদেশিদের রাজনীতি-মনা করতে, জঙ্গিপনা ও সামরিক ভাবনায় সমৃক্ত করতে। আইএস ফুরাত মিডিয়া তাদের ডাবিক প্রপাগান্ডা ম্যাগাজিনে বাংলাদেশিদের জন্য একটি লেখা প্রকাশ করে। শিরোনাম ‘খেলাফত ঘোষণা ও বাংলাদেশ’। এতে জেল ভেঙ্গে ইসলামি জঙ্গিদের মুক্ত করার ডাক দেয়।

সেখানে আশা করা হয়, বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ায় জিহাদের কেন্দ্র। আইএস নেতা আবু বকর আল বাগদাদির প্রতি খোলাখুলি অনুগত্য প্রকাশের আহ্বান জানানো হয়। বাংলাদেশিদের উপদেশ দেয়া হয় গনতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ পরিত্যাগ করার জন্য। বলা হয়, ধর্মনিরপেক্ষবাদি ও নাস্তিকদের মুখ বন্ধ করতে হবে এবং আল্লাহ ও নবীকে অপমান যারা করবে তাদের শিরোচ্ছেদ করতে হবে। সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে আইএসের বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বাংলাদেশিদের আহ্বান জানানো হয়।

বাংলাদেশে অনলাইন ও অফলাইনে হুমকির প্রতিরোধ নেই তেমন। ইন্টারনেটে হুমকি প্রতিরোধ প্রচেষ্টা কম, মানুষ  মোবাইল ফোনে বেশি অভ্যস্ত থাকে, তবে অনলাইনে হুমকির ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। কর্তৃপক্ষের উচিত হুমকি প্রতিরোধে আগাম ব্যবস্থা নেয়া, তা নাহলে হুমকি আরো বেড়ে যাবে।

কাউন্টার র‍্যাডিক্যালাইজেশনের জন্য বাংলাদেশে প্রচেষ্টা লক্ষনীয় নয়, বিশেষ করে যে স্কেলে আদর্শ প্রচার হচ্ছে ছড়ানো হচ্ছে তা মোকাবেলার
জন্য। জঙ্গি মনোভাব পরিবর্তন ও তাদের পূনর্বাসনের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই এটিও একটি দূর্বলতা।কারাগারে জঙ্গি এবং সাধারন অপরাধী একে অপরের কাছে দীক্ষা পাচ্ছে। অনেক পরিকল্পনার কথা শোনা যায়, কিন্তু কোনো পদক্ষেপের কথা শোনা যায় না।


একাকি ভাল্লুকের আঘাত

দীর্ঘ কয়েক বছর দেশে জঙ্গি থাকার কথা অস্বীকার করার মধ্যেই বাংলাদেশে জেএমবি ও হুজি-বাংলাদেশের উত্থান ঘটে। এরা আবার ফিরে আসছে। আল-কায়দা ইন্ডিয়ায়ান সাব-কন্টিনেন্ট-এর সাথে যুক্ত আনাসারুল্লাহ বা আনসার আল-ইসলাম (১-১০) প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে নতুন স্থাপিত আইএস’র সেলগুলোর সাথে।

সাম্প্রতিক কিছু হত্যাকান্ডে পুলিশ আইএস’র সমর্থক সেলের খোঁজ পেয়েছে। তারা পেশাদার খুনিদের সাথে কাজ করছে এবং যদি তাদেরকে নিবৃত করা না যায় তাহলে তারা নিজেরা নিজেদের সক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে।

অনেকে নিজেরাই উদ্বুদ্ধ হয়ে একাকি ভাল্লুকের মতো একক আক্রমন চালিয়ে যেতে পারে। শুধু মুসলিম দেশগুলি নয়, পশ্চিমা দেশগুলিতেও এই রকম একক আক্রমনের ঘটনা ঘটছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে তিউনিসিয়া, ইউরোপ- আমেরিকাতেও কয়েক ডজন একক আক্রমন হয়েছে, যা আইএস দ্বারা উদ্বুদ্ধ।

এধরনের আক্রমন প্রতিহত করা খুব কঠিন। তবে কার্যকর প্রতিকারের নীতি নিতে হবে। কাউন্টার র‍্যাডিক্যালাইজেশনের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে, জঙ্গি মনোভাব দূর করতে ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিতে হবে। গোয়েন্দা,আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যপক সমন্বয় গড়ে তুলে কৌশলগত সক্ষমতার যৌথ উদ্যোগ বাংলাদেশে সাম্প্রতিক আইএস’র যাত্রা শুরুর প্রচেষ্টা রুখে দিতে পারে।

*রোহান গুণারত্ন সিঙ্গাপুরে এস রাজারত্নম স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ভায়োল্যান্স এন্ড টেরোরিজম রিসার্চ-এর প্রধান হিসেবে কর্মরত।

*মন্তব্য প্রতিবেদন মূলত লেখকের নিজস্ব, বেনার নিউজের মতামত নয়।


মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।