নিরাপত্তার অজুহাতে থার্টি ফার্স্ট নাইটের আনন্দে পুলিশের নিয়ন্ত্রণ
2016.12.29
খ্রিস্টীয় নতুন বছর বরণে বাঙালির আনন্দ–উচ্ছাসের লাগাম টেনে ধরার ঘোষণা দিয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী বলছে, নিরাপত্তার স্বার্থে ওই রাতে চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া উন্মুক্ত অনুষ্ঠান না করা, বার বন্ধ রাখাসহ এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা থেকে কেউ কেউ বিরক্ত হতে পারেন।
“নাগরিকের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা পুলিশের উদ্দেশ্য নয়, বরং সবাই যেন শান্তিপূর্ণভাবে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন করতে পারেন সেটি নিশ্চিত করাটাই পুলিশের লক্ষ্য,” বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।
ঢাকা শহরের নিরাপত্তা রক্ষায় ওই রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১০ হাজার সদস্য মোতায়েন রাখার কথা জানিয়ে পুলিশ কমিশনার তাদের সহযোগিতার জন্য নগরবাসীর প্রতি অনুরোধ রেখেছেন। এ ছাড়া কোন কোন রাস্তায়, কখন থেকে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে তার তালিকাও দিয়েছে পুলিশ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অনলাইন নিউজ পোর্টালে গতকাল বলা হয়েছে, আগের বছরগুলোর অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, থার্টি ফার্স্ট নাইট উদ্যাপনের নামে কিছু উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তি নিজস্ব সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকে। এতে আরও বলা হয়, নববর্ষ উদযাপনকালে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির যে কোনও ধরনের আশঙ্কা রোধে পুলিশ বদ্ধপরিকর।
এই প্রেক্ষাপটে ডিএমপি কমিশনার পুলিশের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত জানানোর পর কিছু প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কেউবা বলছেন, এটা পুলিশের বাড়াবাড়ি।
“এভাবে মানুষের আনন্দ–উৎসবে বাধা দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না। ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে কড়া নিরাপত্তার মধ্যেও সন্ত্রাসী হামলা বন্ধ করা যায়নি,” বেনারকে বলেন সংস্কৃতিকর্মী প্রমথেশ শীল।
তাঁর মতে, মানুষের মধ্যে এই সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করার পাশাপাশি নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করতে হবে।
বাঙালি পহেলা বৈশাখে নববর্ষ ও থার্টি ফার্স্টে খ্রিস্টীয় নতুন বছরকে স্বাগত জানায় বেশ আনন্দের সঙ্গে। বাংলা নববর্ষে বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের আলোকে আচার–অনুষ্ঠানে মেতে ওঠে বাঙালি। আর থার্টি ফার্স্টের চেহারা থাকে কিছুটা আন্তর্জাতিক, এটা মূলত পালন করে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা।
থার্টি ফার্স্টে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মূল নজর থাকে ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারা ও ধানমন্ডি এলাকায়। এর বাইরে তাদের মনযোগের আরেকটি জায়গা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি), যেখানে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে জড়ো হন। এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাসিন্দা নন, এমন ব্যক্তিদের সন্ধ্যার পর ওই এলাকায় প্রবেশ না করার আহ্বান জানিয়েছে পুলিশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন উপ–কমিশনার বেনারকে বলেন, “পুলিশ কমিশনার আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং করার পর এ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে শুধু বলব, নিরাপত্তার স্বার্থে এসব সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া উচিত। বিদায়ী বছর হলি আর্টিজান রেস্তোঁরা, শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠসহ কিছু জায়গায় জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে, যার ফলে সঙ্গত কারণেই বাড়তি সতর্কতা নিতে হয়েছে।”
এবার ঢাকা মহানগর পুলিশের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ছয়টা থেকে ১ জানুয়ারি ভোর পাঁচটা পর্যন্ত সব ধরনের বার, ক্লাব ও রেস্তোরাঁ বন্ধ রাখতে হবে। আতশবাজি করা যাবে না, ফোটানো যাবে না পটকাও।
পুলিশের ওই সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সন্ধ্যা ছয়টার পরে সাধারণ মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। পরিচয়পত্র দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীই কেবল ঢুকতে পারবেন।
কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকায় চলাচলের ক্ষেত্রেও। ওইসব এলাকার বাসিন্দাদের রাত ৮টার মধ্যে নিজের এলাকায় ফিরতে বলা হয়েছে। এরপর ঘরে ফিরতে হলে মহাখালীর আমতলী ও কাকলীতে পুলিশ তাদের তল্লাশি করবে।
পুলিশ জানিয়েছে, শনিবার রাত আটটার পর হাতিরঝিল এলাকায় কোনো গাড়ি ঢুকতে দেওয়া হবে না। গুলশান, বনানী ও বারিধারা থেকে কোনো গাড়ি হাতিরঝিল দিয়ে বের হতে পারবে না। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সময়ে হাতিরঝিল এলাকা হয়ে উঠেছে অন্যতম বিনোদনকেন্দ্র, যেখানে মানুষ ঘুরতে বা বেড়াতে যায়।
থার্টি ফার্স্ট নাইটে বিনোদনের অন্যতম জায়গা হোটেলগুলোর ওপরও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বনানী এলাকায় কয়েকটি পাঁচ তারকা হোটেল বিদেশিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় খোলা থাকবে। রেস্তোরাঁয় কেউ অনুষ্ঠান করতে চাইলে পুলিশের বিশেষ অনুমতি নিতে হবে। আর বাসার ভেতরে অনুষ্ঠান করতে হলে পুলিশকে জানাতে হবে। পুলিশ নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যবস্থা করবে।
আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, “থার্টি ফার্স্ট নাইটে সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে রাস্তার মোড়, ফ্লাইওভার বা রাস্তায় কোনো ধরনের জমায়েত বা উৎসব করা যাবে না।”
“নিরাপত্তার কারণে মানুষের জীবনে আচার–অনুষ্ঠানের ধারাও পাল্টে যাচ্ছে। পুলিশ বাইরে নয়, ঘরে অনুষ্ঠান করতে বলছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এভাবে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করে স্মার্টলি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারত,” বেনারকে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও ঠিকাদার গাজী মিজান, যিনি থার্টি ফার্স্ট নাইটে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যান বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে।
গাজী মিজান বলেন, সেই কবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়েছি, তবু সেই স্মৃতি নস্টালজিয়া হয়ে আছে। বছরে দুই তিনবার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যাই, যার একটি হচ্ছে থার্টি ফার্স্ট নাইট। এবার তাও যেতে পারব না।
নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ এসব সিদ্ধান্ত নিলেও নাশকতার আগাম কোনও তথ্য আছে কিনা জানতে চাইলে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ কমিশনার বলেন, সে রকম কোনও তথ্য নেই। তবে সবাইকে চোখ–কান খোলা রাখতে হবে।