দুদকের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে ছয় মাসে গ্রেপ্তার ৩১৫
2016.10.05
বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে না কমেছে—এই আলোচনা ও যুক্তিতর্ক আছে সব মহলেই। দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবির সর্বশেষ ২০১৫ সালের গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর অপরিবর্তিত থাকলেও অবস্থানের এক ধাপ অবনতি হয়েছে।
অন্যদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা স্টোর ফর পলিসি ডায়লগ—সিপিডি বলছে, দুর্নীতির প্রকোপ কিছুটা কমেছে। এ প্রসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশন—দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ গতকাল বুধবার বলেন, “সিপিডি দুর্নীতি কমার কথা বললেও কীভাবে তারা এটি বলল, তা জানি না। আমার কাছে মনে হয় দুর্নীতির প্রকোপ আশানুরূপ কমেনি।”
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে দুর্নীতি কমে আসার তথ্য পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদ প্রকাশ করেন দুদক চেয়ারম্যান। আর সেই লক্ষ্যে দুদক দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করেছে।
গত প্রায় ছয় মাসে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মোট ৩১৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে, যাদের মধ্যে ব্যাংক কর্মকর্তা ও ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া ব্যক্তির সংখ্যা শতাধিক।
এ বছরের ২৭ মার্চ থেকে গ্রেপ্তার অভিযান জোরদার করে দুদক, এর আগে ১৪ মার্চ দুদকের নতুন চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ যোগ দেন।
সাম্প্রতিক সময়ে দুদকের কাজকর্ম নিয়ে ব্যাপক আলোচনা–সমালোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে দু্জন প্রকৌশলীকে গ্রেপ্তারের পর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কর্মকর্তা–কর্মচারীরা কাজ বন্ধ করে বিক্ষোভ করেছেন। তাঁদের পক্ষ নিয়ে গত মঙ্গলবার গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী গণমাধ্যমের কাছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। বুধবার এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান বক্তব্য দেন।
দুদক সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হওয়া ৩১৫ জনের মধ্যে রাজউক এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা–কর্মচারী, সাব রেজিস্ট্রার, ভূমি কর্মকর্তা, পাসপোর্ট বিভাগের কর্মকর্তা, ওয়াসার প্রকৌশলী, চিকিৎসকসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা রয়েছেন।
গত ছয় মাসের গ্রেপ্তার অভিযানে রাজউকের ছয়জন কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হন। এদের মধ্যে ১১ এপ্রিল গ্রেপ্তার হন একটি প্রকল্পের পরিচালক একেএম শফিকুর রহমান। ২৯ আগস্ট গ্রেপ্তার হন দুজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী মো. ছাইদুর রহমান এবং মো. মনোয়ারুল ইসলাম।
গত মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে দুদকের সাম্প্রতিক গ্রেপ্তার অভিযানের সমালোচনা করে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন বলেন, “দুদক রাজউকে অভিযান চালাক কোনো অসুবিধা নেই, তবে ডিস্টার্ব করলে অসুবিধা আছে। আমি মনে করি নো বডি ইজ ট্রান্সপারেন্ট।”
দুদক সম্পর্কে একজন মন্ত্রীর এই বক্তব্য প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে বিভিন্ন মহলে। এর জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বুধবার বলেন, কারও কথার ভিত্তিতে কথা বলা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাজ নয়। দুদক কারও কাজে হস্তক্ষেপও করে না। সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করাই দুদকের কাজ।
বুধবার সেগুনবাগিচায় দুদক কার্যালয়ে বাংলাদেশ গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
“দেশব্যাপী আমরা দুর্নীতি বিরোধী একটি আওয়াজ তুলতে চাই। আমরা চাই, সবাই আইন মেনে চলুক। আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করুক,” অনুষ্ঠানে জানান ইকবাল মাহমুদ।
এদিকে অর্থ আত্মসাতের মামলায় দুই প্রকৌশলী গ্রেপ্তার হবার পর দুদকের বিরুদ্ধে রাজউক কর্মীদের বিক্ষোভে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে টিআইবি এবং সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজন।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বেনরাকে বলেন, “নির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেপ্তার হবার পরও রাজউক কর্মীদের এ বিক্ষোভ সরকার ঘোষিত সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের প্রতি তাদের অনাস্থার পরিচয়। এমন পরিস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য নয়।”
এ ধরনের অবস্থান বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতি অবমাননাকর উল্লেখ করে ড. ইফতেখার বলেন, আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়া উচিত।
নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “নিরপেক্ষভাবে দুদক কাজ করতে পারলে দুর্নীতি দমনে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু দুর্নীতির নির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেপ্তার করার পরও রাজউক কর্মীরা বিক্ষোভ করে সরকারঘোষিত সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের প্রতি অনাস্থার পরিচয় দিলেন। এটা মোটেও কাম্য নয়”।
রাজউক ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন। ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ পেয়ে ফাঁদ পেতে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে সংস্থাটি।
অবৈধভাবে ঋণ দেওয়ার অভিযোগে দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হন অগ্রণী ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মিজানুর রহমান খান। পলাতক রয়েছেন ওই ব্যাংকের সদ্য সাবেক এমডি সৈয়দ আব্দুল হামিদ। একই মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন মুন গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান।
দুর্নীতির মামলায় বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের চাকরিচ্যুত অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান, ফার্স্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ইফতেখার হোসেন, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের সিলেট শাখার ম্যানেজার মো. হোসেন আহমদ; এবি ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি ও বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক বদরুল হক খান, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. শওকত ইসলাম, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের সাবেক অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. ইনামুল হক; সোনালী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখার সাবেক প্রিন্সিপাল অফিসার মো. নুরুজ্জামান; সোনালী ব্যাংকের ভালুকা শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক মো. একরামুল হক খান ও সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মো. আসাদুজ্জামান; রূপালী ব্যাংকের ঢাকার নবাবগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক ফরিদ আহম্মদ; অগ্রণী ব্যাংকের বংশাল শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার মো. ফারুক আহমেদ প্রমুখ এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন।
এ ছাড়া পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় পরিচালক মুনসী মুয়ীদ ইকরাম, পাসপোর্ট অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবসরপ্রাপ্ত) মো. রফিকুল ইসলাম, ঢাকা ওয়াসার অবসরপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আরজেএম রবিউল কাউসার, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মেজবাউল করিম দুদকের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন।
মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতি করে চাকরি নেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছেন ২০ জন শিক্ষানবিশ পুলিশ কনস্টেবল। গত ২৯ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হন কোস্ট গার্ডের সাবেক মহাপরিচালক সফিক-উর-রহমান। সর্বশেষ বুধবার ভোরে গ্রেপ্তার হন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) উপ পরিচালক তামজীদ সারোয়ার।
দুদক সন্তুষ্ট নয়
দুদকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন মামলায় ৩১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে দুর্নীতি মামলায় সাজার হার ৩৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৯ দশমিক ৬৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
এ সময়ের মধ্যে ২০৬টি মামলা কমিশন অনুমোদন দিয়েছে। এর আগেরসহ ৩১৬টি মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে। ৩০১টি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে।
তবে সংস্থাটির কাজকর্মে এখন পর্যন্ত সন্তুষ্ট নন দুদক চেয়ারম্যান।
“দুর্নীতি নির্মূল করা যাবে না, কিন্তু গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নামিয়ে আনতে হবে। সেই চেষ্টাই আমরা করে যাচ্ছি,” জানান দুদক চেয়ারম্যান।
এদিকে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে স্বাগত জানিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বেনারকে বলেন, দুর্নীতি কমাতেই হবে।
“তবে দুদকের অতীত বেশকিছু কাজকর্ম নিয়ে সমালোচনা আছে। দুর্নীতি দমন করতে গিয়ে কিছু কর্মকর্তার দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার উদাহরণ আছে। তাই যারা দুর্নীতি দমনের কাজটি করবেন তাদের সততা ও নিষ্ঠা প্রমাণ করতে হবে সবার আগে,” জানান রাশেদা কে চৌধুরী।