পোকার উপদ্রবে আসামের হাজার হাজার একর জমির ধান ধ্বংস
2016.09.16

ধান চাষী নিরঞ্জন দেকার সারা বছরের মেহনতের ফসল কয়েকঘন্টা ধরে চলা পোকার আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গেছে।
নিরঞ্জন দেকা বেনার নিউজকে বলছিলেন, “আমার ফসল ঘরে তোলার সময় হয়ে এসেছিল। সব শেষ। ২৪ ঘন্টার কম সময়ের ব্যবধানে আমার এক একরেরও বেশি জমির ধান পোকায় ধ্বংস করে ফেলল।”
দেকার বাড়ি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে। অসহায়ত্ব প্রকাশ করে তিনি বললেন, “তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলাম না।”
নিরঞ্জন দেকার মতো আসামের অসংখ্য কৃষকের সামনে এখন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। আসাম ভারতের অন্যতম প্রধান ধান উৎপাদনকারী অঞ্চল। পোকার আক্রমণে আসামে ধানের ফলন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবার।
রাজ্যের কৃষি বিভাগ বলছে, আসামের ২২টি জেলার ৮৭ হাজার একর জমির ধান একবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পোকার আক্রমণে ক্ষতির শিকার হয়েছেন প্রায় এক লাখ কৃষক। স্থানীয়ভাবে এই পোকাকে বলা হয় শুরপুক, আবার পোকাটি আর্মিওয়ার্ম নামেও পরিচিত। বাংলাদেশে এটিকে বলা হয় শুঁয়াপোকা।
আসামের কৃষিমন্ত্রী অতুল বোরা বেনার নিউজকে বলেন, “পোকার আক্রমণে রাজ্যের কৃষিখাতে অভাবনীয় এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে সমস্যাটা মহামারীর রূপ নিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, এ রাজ্যে এ যাবৎকালে পোকাদের এটিই বৃহত্তম আক্রমণ।”
দক্ষিণ এশিয়ায় বর্ষাকালীন বন্যার পর সাধারণত এই পোকার উপদ্রব দেখা যায়। কয়েকসপ্তাহ আগে বন্যায় আসাম ও ধান উৎপাদনকারী আরেক বৃহৎ রাষ্ট্র বাংলাদেশের কিছু অংশ পানিতে তলিয়ে যায়।
বোরা বলেন, তিনি নয়াদিল্লিতে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতাদের এই পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিয়েছেন। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাঁদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব
সবশেষ ১৯৬৭ সালে আসামে পোকার আক্রমণ হয়েছিল। কিন্তু সে দফায় ক্ষতি এত ব্যাপক মাত্রায় ছিল না বলে বিশেষজ্ঞদের মত। তাঁরা বলছেন, ধ্বংস ঠেকাতে আসলে তেমন কিছুই করার ছিল না।
“শুঁয়োপোকা ধানের সবচেয়ে ক্ষতিকর পোকাগুলোর একটি। গবাদি পশু দিয়ে হাল চাষের পর জমির যে চেহারা হয়, এ ধরনের পোকার আক্রমণের পর ক্ষেতের চেহারা তেমন হয়ে থাকে। ধান ক্ষেতের আশেপাশে এই পোকার উপস্থিতি দেখামাত্র ধ্বংস করে ফেলা প্রয়োজন। কিন্তু একবার ধানক্ষেতে ঢুকে পড়লে আর কিছুই করার থাকে না”, গুয়াহাটির কৃষি বিশেষজ্ঞ কবীন্দ্র বর্কতকী বেনার নিউজকে বলেন।
তিনি আরও বলেন, “প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষীরা এই আক্রমণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির স্বীকার হবেন”।
আসামের সাম্প্রতিক বন্যায় ১৯ মিলিয়ন রুপির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষুদ্র চাষীরা কোনোরকমে ধানের চারা বুনতে পেরেছিলেন। সেই ধানই অক্টোবরে ঘরে তোলার কথা ছিল বলে জানান বর্কতকী।
“কিন্তু এখন, যে কৃষকদের কোনো সঞ্চয় নেই তাদের আর কিছুই রইল না। সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা না পেলে এই কৃষকদের অনাহারে থাকা ছাড়া গতি নেই,” মন্তব্য করেন ওই বিশেষজ্ঞ।
অলৌকিক কিছু ঘটার প্রত্যাশা
যখন রাজ্য সরকার নয়া দিল্লীর সাহায্যের প্রত্যাশায়, তখন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা আলো জ্বেলে ও নানারকম ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠান করে অলৌকিক শক্তিকে আহ্বান জানাচ্ছেন ফসল বাঁচাতে।
গোলাঘাট জেলার কৃষক পলাশ বোরা বেনার নিউজকে বলেন, “আমার পরিবারের সদস্যরা না খেয়ে মারা যাচ্ছে, আর আমি নিশ্চুপ বসে আছি, এমনটা হতে পারে না। এখন ঈশ্বরই ভরসা। নইলে আত্মহত্যা করা ছাড়া আমার সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।”
ভারতের এক দশমিক ২৫ বিলিয়ন জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশ কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বন্যা, খরা, পোকার আক্রমণে প্রত্যাশিত ফসল না পেয়ে প্রতিবছর হাজার হাজার কৃষক আত্মহত্যা করেন।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে ভারত জুড়ে পাঁচ হাজার ৬০০ কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। ব্যাংক ঋণ নিয়ে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া ও ধারদেনা শোধ করতে না পারার কারণে কৃষকেরা আত্মহত্যা করেন। সুনির্দিষ্ট সরকারি সহায়তার অভাবে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় বলে ব্যুরোর সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে।
আসামের একজন কৃষক নেতা অখিল গগই বেনার নিউজকে বলেন, “চার দিন হয় এলাকায় পোকার আক্রমণ শুরু হয়েছে। আক্রমণ কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না।”
তিনি বলেন, “কৃষকদের সহায়তা করতে সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা নেই। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। সরকার যদি যথাসময়ে উদ্যোগ না নেয়, আমার ভয় হচ্ছে যে কৃষকদের চড়ামূল্য দিতে হবে।”