অভিজিৎ রায়ের হত্যাকারী সন্দেহে ছয় জনের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.08.22
20160822-AvijeetRoy-Video1000.jpg গত রোববার ডিএমপির ফেসবুক পেজে অভিজিৎ রায়ের সন্দেহভাজন খুনিদের পৃথক সাতটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করা হয়। আগস্ট ২২, ২০১৬।
ডিএমপি

ঘটনার দেড় বছর পর বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের সন্দেহভাজন ছয়জন খুনির ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ। যাদের একজন ইতিমধ্যে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। বাকি পাঁচজনের সম্পর্কে তথ্য দিতে দেশবাসীকে আহ্বান জানানো হয়েছে।

অভিজিৎ হত্যার ঘটনায় এ পর্যন্ত আটজন গ্রেপ্তার থাকলেও তাদের সঙ্গে ভিডিও ফুটেজের ব্যক্তিদের মিল নেই বলে জানিয়েছে পুলিশ।

গত দেড় বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অভিজিৎ হত্যার ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে আসলেও প্রকৃত খুনিদের ধরতে পারেনি পুলিশ। অভিজিৎ রায়সহ একের পর এক ব্লগার হত্যার ঘটনায় খুনিদের আটক করতে না পারার সঙ্গে পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতি দেখছেন বিশ্লেষকেরা।

যা আছে ভিডিওতে

গত রোববার বিকেলের দিকে ডিএমপির ফেসবুক পেজে অভিজিৎ রায়ের হত্যার সঙ্গে জড়িত ছয়জন সন্দেহভাজনের সাতটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করা হয়। যাদের একজন মুকুল রানা গত ১৯ জুন পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে।

সেসময় পুলিশের পক্ষ থেকে তার নাম শরীফুল ইসলাম শরীফ ওরফে হাদি (৩৫) জানিয়ে, অভিজিৎ রায়কে সে নিজেই কুপিয়ে হত্যা করে বলে দাবি করা হয়। তাকে ধরিয়ে দিতে পুলিশ পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল।

পুলিশের সূত্র জানায়, অভিজিৎ হত্যার পরপরই একুশে বইমেলা উপলক্ষে স্থাপিত  সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে এসব ফুটেজ বিশ্লেষণ করে খুনিদের চিহ্নিত করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। রোববার প্রকাশ পাওয়া ভিডিওতে থাকা বাকি পাঁচজনের পরিচয় এখনো জানতে পারেনি পুলিশ।

প্রকাশিত ফুটেজে চিহ্নিত ওই ব্যক্তিদের সম্পর্কে তথ্য দিতে দেশবাসীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন ডিএমপির মিডিয়া ও গণসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মো. মাসুদুর রহমান।

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী সংলগ্ন এলাকায় খুন হন লেখক অভিজিৎ রায়। মারাত্মকভাবে আহত হন তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। একজন ফটোসাংবাদিক আহত অবস্থায় তাঁদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে অভিজিৎ রায়কে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা।

এর পরদিনই ওই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয় আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ বাংলাদেশ শাখা (একিউআইএস) আনসার আল ইসলাম।

ডিএমপির প্রকাশ করা সাতটি ভিডিও ফুটেজে সেদিন (২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫) বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ফটকের কাছে পাঞ্জাবি পরা এক তরুণকে পায়চারী করতে দেখা যায়। তখন সময় বিকেল চারটা এক মিনিট। এর কয়েক মিনিট পরেই সাইকেলের হাতলে কিছু একটা ঝুলিয়ে বইমেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে আরেক তরুণ।

সিসিটিভির সময় অনুযায়ী বিকেল ৪টা ২৪ মিনিট ১৬ সেকেন্ডের সময় পাঞ্জাবি পরা তরুণের সঙ্গে যোগ দেয় আরও দুই তরুণ। এদের একজন লম্বা হাতার ফতুয়া বা গেঞ্জি পরিহিত এবং পিঠে ব্যাগ ছিল। এই তিনজনই একসঙ্গে মেলায় প্রবেশ করে।

ভিডিওতে দেখা যায়, পাঞ্জাবি পরা তরুণ সাইকেল চালিয়ে মেলার ফটক দিয়ে সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটে বেরিয়ে আসে। তখন সাইকেলটিতে ওই ব্যাগ ছিল না।

এরপর রাতের ফুটেজে অভিজিৎ রায় ও তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বইমেলার ফটক দিয়ে বেরিয়ে টিএসসির দিকে ফুটপাত ধরে হাঁটছেন। এসময় অপেক্ষারত মুকুল রানাকে ফুটপাত ধরে তাঁদের অনুসরণ করতে দেখা যায়। ঠিক একই সমান্তরালে ফুটপাতের পাশের মূল সড়ক ধরে লম্বা হাতার ফতুয়া পরা যুবক ও চশমা পরা মোটা আরেক তরুণ হাঁটছিল। ফতুয়া পরা তরুণটির হাতে কাগজে মোড়ানো কিছু একটা দেখা যায় ভিডিওতে।

আটক আটজন, কেউই ভিডিও ফুটেজে নেই

পুলিশ সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আটজন গ্রেপ্তার রয়েছে। এদের মধ্যে ইন্টারনেটে উগ্রবাদের প্রচারক ব্লগার শফিউর রহমান ফারাবী এবং মান্নান ইয়াহিয়া ওরফে মান্নান রাহী, যিনি সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস খুনেরও উল্লেখযোগ্য আসামি। তবে তাদের কেউই পুলিশের সম্প্রতি প্রকাশ করা ভিডিও’তে নেই।

এ প্রসঙ্গে অভিজিৎ হত্যা মামলার তদন্তের সঙ্গে জড়িত ডিবির উপকমিশনার (দক্ষিণ) মাশরুকুর রহমান খালেদ বেনারকে বলেন, “ভিডিওতে যে ছয় সন্দেহভাজনকে চিহ্নিত করা তাদের একজন ধরা পড়ার সময় বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। বাকিদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।”

তিনি জানান, “এ মামলায় ফারাবিসহ যে আটজন আটক রয়েছে তারা ভিডিওতে চিহ্নিতদের কেউ নন।”

তবে প্রকৃত দোষীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

বারবারই অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছে তাঁর পরিবার। এর আগে অভিজিতের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায়ের বেনারকে বলেছিলেন, “মামলাটির তদন্ত নিয়ে একেক সময় একেক তথ্য দিচ্ছে পুলিশ। কখনও বলছে তারা বিদেশে পালিয়ে গেছে। কখনও আবার বলছে একজন বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে।”

এর পর তিনি বলেন, “অভিজিৎ হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে পত্র পত্রিকা ছাড়া আমি এখন আর কিছুই জানতে পারি না।”

এদিকে ই–মেইলে যোগাযোগ করা হলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অভিজিতের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা বেনারকে বলেন,  “অভজিৎ হত্যার তদন্ত বিষয়ে আমার সঙ্গে দেশ থেকে কেউ কখনও যোগাযোগ করেনি”।

গাফিলতির অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে

ঘটনার প্রায় দেড় বছর পর অভিজিৎ হত্যায় সন্দেহভাজনদের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশের এই দীর্ঘসূত্রতাকে পুলিশের গাফিলতি হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান বেনারকে বলেন, “অভিজিৎ রায়ের সন্দেহভাজন খুনিদের ভিডিও প্রকাশ অবশ্যই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির খবর। তবে কয়েকদিনের ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করতে দেড় বছর লাগাটা অবিশ্বাস্য।”

তাঁর মতে, “এতে মূলত অভিজিৎ রায়সহ সকল ব্লগার হত্যার তদন্ত বিষয়ে পুলিশের গাফিলতিই প্রমাণিত হয়। যার ফলে অপরাধীরা অনুপ্রাণিত হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “ব্লগারদের হত্যা করার জন্য তাঁদের লেখালেখিকে দায়ী করা হত। বিভিন্ন সময় ব্লগারদের ধর্ম বিরোধিতাকারী হিসেবেও দাঁড় করানো হয়। পুলিশের মধ্যেও এর প্রভাব পড়েছে। ফলে এসব মামলা তদন্তে খানিকটা দ্বিধান্বিত তাঁরা। না হলে প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হচ্ছে না কেন?”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।