অভিজিৎ রায় হত্যার ঘটনা অমীমাংসিত

বেনার নিউজ
2015.03.09
BD-protest নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন, হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে কর্তৃপক্ষের আদৌ কোনো দৃঢ় প্রতিজ্ঞা আছে কিনা।
এএফপি

নিরপেক্ষ বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে কর্তৃপক্ষের আদৌ কোনো দৃঢ় প্রতিজ্ঞা আছে কিনা সন্দেহ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ব্লগার ও লেখক অভিজিত রায়ের নির্মম হত্যাকান্ডের প্রায় ২ সপ্তাহ পার হলো, কিন্তু কারা হত্যাকান্ডের ঘাতকদের পুলিশ এবং তদন্তকারী সংস্থা এখনো খুঁজে বের করতে পারে নাই।

যদিও এখন পর্যন্ত ২ জন গ্রেফতার হয়েছে, পুলিশ রোববার নাগাদ স্বীকার করেছে যে, গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে তারা প্রকৃত তথ্য পায় নি, তারা অনুসন্ধানের ক্ষেত্র আরো বাড়িয়ে নিতে যাচ্ছে, সেজন্য সন্দেহভাজন ১০ জনের একটি তালিকা করেছে যাদের বিরুদ্ধে অভিজিৎ-কে হত্যার হুমকি দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের গোয়েন্দা শাখার জয়েন্ট কমিশনার মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, " আমাদের কাছে পরিস্কার কোনো ক্লু বা ধারনা নেই। প্রধান সন্দেহভাজন যাকে আটক করা হয়েছে, সে অভিজিৎ হত্যায় তার কোনো প্রকার সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করেছে।" তিনি এক সপ্তাহ আগে আটককৃত শফিউর রহমান ফারাবীর প্রসঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন। ফারাবী ফেসবুকে অভিজৎ-কে হুমকি দিয়ে আসছিলো 'মুক্ত-মনা'র ব্লগে ইসলাম সম্পর্কে তার লেখার জন্য, যেটি তিনি প্রায় ১০ বছর আগে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

আটককৃত দ্বিতীয় সন্দেহভাজনের নাম এখনো প্রকাশ করা হয়নি। যদিও কয়েক ঘন্টার মধ্যে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। তদন্তকারীরা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার কোনো সংশ্রব খুজে পায় নি।

অভিজিতের পরিবার ও বন্ধুদের জন্য আরো হতাশের ব্যাপার যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগত এফবিআই সদস্যরা তাদের ৪-দিনের তদন্তে শক্ত কোনো প্রমাণ বের করতে পারে নি বলে ধারনা করা হচ্ছে।
এফবিআই এজেন্টরা ঢাকায় এসেছেন কারিগরি ও ফরেনসিক সহায়তা দিতে, যেহেতু ৪২ বছর বয়স্ক অভিজিৎ আমেরিকার নাগরিক, তার স্ত্রী ব্লগার রাফিদা আহমেদ বন্যা সহ আটলান্টায় বসবাস করছিলেন, তার স্ত্রীও মারাত্নকভাবে আহত হন ও একটি আঙ্গুল হারান এবং  তাকে আমেরিকায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

এই টিমের অগ্রগতি সম্পর্কে জানাতে গিয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন," তারা এই হত্যার তদন্ত কাজে কারিগরি সহায়তা দিতে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।"
অভিজিতের হত্যার ঘটনা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এবং টিভিতে বিশাল ভাবে প্রকাশ পায় এবং এই সব প্রতিবেদনে ব্যপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে এই ঘটনা আগের বড় বড় হত্যাকান্ডের মতোই পরিনতি পাবে।

স্বাধীন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা নজির হিসেবে উল্লেখ করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ যিনি ইসলামি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লেখালেখির জন্য ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হত্যার লক্ষ্য হয়ে উঠেছিলেন। ঘটনার ৩ মাস পর জার্মানীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজাদ মারা যান। পুলিশ গত ১১ বছরে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে পারে নি।

২০১৩ সালে আরেকজন নাস্তিক ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে ইসলামের স্বঘোষিত রক্ষাকারীরা নির্মমভাবে খুন করে। যদিও পুলিশের হাতে ধরা পড়া হত্যাকারীরা স্বীকার করেছে যে তারাই হত্যা করেছে রাজীবকে, কিন্তু তাদের মধ্যে কাউকেই বিচার করে সাজা দেয়া হয়নি। প্রধান কারন জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি আইনী প্রক্রিয়া।

বিশ্লেষকরা হামলাকারী ইসলামি জঙ্গিদের খুঁজে না পাওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ বের করেছে। সেগুলো হচ্ছে কর্তৃপক্ষের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার অভাব, দূর্বল প্রশিক্ষণ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাজের সহায়ক অর্থ তহবিলের অপর্যাপ্ততা।

মহিউদ্দিন আহমেদ একজন সাবেক কূটনীতিক এবং কলামিস্ট যিনি প্রায়শই ধর্মীয় উগ্রবাদীদের বিপদ সম্পর্কে তার লেখায় তুলে ধরে আসছেন, বলেন," অতীতের নজির অনুযায়ী অভিজিতের হত্যাকারীদের খুঁজে পেতে এবং সাজা প্রদানের ব্যাপারে আমার তেমন কোনো আশা নেই।" তিনি বলেন, " এটা খুবই অচিন্তনীয় ব্যাপার যে, এইসব বড় বড় লোকজনের হত্যাকারীদের ঘটনা অমীমাংশিত থেকে যাবে এবং তারা বার বার বিচারের বাইরে থেকে যাবে"।

আইনজীবি এবং অধিকার কর্মি সারা হোসেন বলেন,"হত্যাকারীদের সাজা প্রদানে ব্যর্থতা নিঃসন্দেহে আইনের শাসনের বিরুদ্ধেই যায়। হামলাকারীরা যদি সাজা না পায়, এইরকম ঘটনা আরো ঘটতে থাকবে"।

নিজের ক্ষতি হবার ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাবেক সরকারী কর্মকর্তা বলেন, অপরাধীদের ধরার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা বা প্রতিজ্ঞার ব্যাপারে তার সন্দেহ রয়েছে। তার মতে," আধুনিক প্রশিক্ষণ ও পর্যাপ্ত তহবিল ছাড়া কি করে আশা করতে পারি যে আইন প্রয়োগকারী ব্যক্তিরা ও তদন্তকারীরা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করবে?"

"তারা মূলত সাবমেরিন এবং আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম কিনতে বেশি আগ্রহী, যদিও আমাদের জাতীয় নিরাপত্তায় বহিঃশক্তির কোনো দৃশ্যমান হুমকি নেই। তারা মূলত সেনাবাহিনীকে খুশি রাখতে চায় এবং ভবিষ্যতে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহন থেকে বিরত থাকবে এবং তাদের ক্ষমতায় থাকা অব্যাহত থাকবে সেটা নিশ্চিত করবে", তিনি বলেন আরো।

উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে সেনাবাহিনীর অন্তত ৩ বার হস্তক্ষেপ এবং নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যূত করার ইতিহাস রয়েছে।

তিনি আরো জানান, " এটা এখন পরিস্কার, শেখ হাসিনার সরকার বিএনপি ও এইদলের প্রধান খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলা করতে পারছে না। তারা বরং বিরোধী পক্ষকে দমন করার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উপর বেশি নির্ভর করছে, এবং তারা আসল কাজ থেকে সরে যাচ্ছে।"

মূলত, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও তার জোটকে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ বা প্রতিবাদী মিছিল  করতে দেয়া হচ্ছে না, দলীয় নেতাদের গণ-গ্রেফতার করা হচ্ছে। তাদের সমর্থকদের বাধ্য করছে অদৃশ্য থাকতে এবং গত ২ মাস ধরে অবরোধ ও হরতাল ডাকতে। আর এইসব সারা বাংলাদেশে প্রয়োগের জন্য তারা ককটেল ও পেট্রোল বোমা মেরে চলেছে।

সংঘাত ও হিংস্র কর্মসূচির কারনে ইতোমধ্যে শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, যাদের মধ্যে অনেকে নারী ও শিশু। শান্তিপূর্ণভাবে এই সঙ্কট শিঘ্রই মিটিয়ে ফেলার জন্য সরকার ও বিরোধী পক্ষ কেউই কোনো আশা পূরণ করছে না।

বাংলাদেশে ক্রমাগত আশংকা তৈরি হচ্ছে যে, ৪৪ বছর আগে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে ধর্মনিরপেক্ষ ও গনতান্ত্রিক যে রাষ্ট্র তৈরি হয়েছিল,  ক্রমাগত নিকট ভবিষ্যতে তার ভিত্তিভূমি ভেঙ্গে পড়তে যাচ্ছে ধর্মীয় চরমপন্থিদের কার্যক্রমে। এসব ঘটে চলেছে সরকারে 'শুন্য সহনশীল' নীতি সত্তেও।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিজামুদ্দিন আহমেদ জানান, " ধর্মীয় দলগুলোর প্রতি তোষামদের মাধ্যমে সরকার দলীয় অর্জনের সাফল্য লাভের প্রচেষ্টাই বাংলাদেশে চরমপন্থীদের উদ্ভবের জন্য দায়ী। এটা ক্রমাগত উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠছে যে অদূর ভবিষ্যতে দেশটি ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র-আদর্শ ধরে রাখতে পারবে কিনা।"

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।