বাঙালির জীবনে উৎসবের রং ছড়িয়ে দিল পহেলা বৈশাখ

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.04.14
BD-boishakh ১৪২২ বঙ্গাব্দকে বরণ করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেয় হাজার হাজার মানুষ। ১৪ এপ্রিল,২০১৫
বেনার নিউজ

পুরোনো বছরের গ্লানি ব্যর্থতা ঝেড়ে ফেলে নতুন বছর ১৪২২ বঙ্গাব্দকে স্বাগত জানিয়েছে উৎসব মুখর বাঙালি। ১৪ এপ্রিল বিপুল আনন্দ উৎসবের মধ্যে দিয়ে সারা দেশের উদ্‌যাপিত হয়েছে বর্ষবরণ উৎসব।

টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া–সারা বাংলায় ছিল বিপুল আনন্দের উচ্ছ্বাস। ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশা, বয়স নির্বিশেষ সকল মানুষ শামিল হন বৈশাখী উৎসবে। তারা আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারের গৌরব ধারণ করেন হৃদয়ে।

রাজধানী ঢাকা আক্ষরিক অর্থেই আনন্দ নগরীতে পরিণত হয়েছিল। দিনের শুরু থেকেই নানা বয়সী সুসজ্জিত নগরবাসীর স্রোত নেমেছিল রাজপথে। নারীদের পরনে ছিল লোকজ নকশা খচিত সুতি শাড়ি। প্রাধান্য পেয়েছিল লাল-সাদা রং।

অনেকের মাথায় ছিল তাজা ফুলের মালা জড়ানো। শিশুদেরও ছিল লাল-সাদার সজ্জা। পুরুষদের পরনে প্রধানত ছিল পায়জামা-পাঞ্জাবি ও ফতুয়া। অতীতের বৈশাখী উৎসবগুলোর তুলনায় এবার নগরীতে উৎসব মুখর মানুষের ঢল ছিল অধিক।

পোশাক-পরিচ্ছদের মতো আহারেও প্রাধান্য ছিল বাঙালির চিরকালের পছন্দের খাদ্যগুলো। পান্তা, ইলিশ, হরেক রকমের ভর্তা, ভাজি, আচার, চাটনিতে তৃপ্ত হয় রসনা। আহারে-বিহারে কেটে যায় বছরের প্রথম দিনটি।

বাঙ্গালী সংস্কৃতি থেকে উৎসারিত পহেলা বৈশাখ উদযাপন অর্থনীতি ও বিনোদনের অগ্রপথিক। কিন্তু এবার ব্যবসায়ীদের মন ভালো নেই। কারণ কেনাবেচা কম।


“গত তিনমাসের রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে ক্রেতাদের মধ্যে। এজন্য বেচাকেনা বেশ কম হয়েছে,”বেনারকে  জানান বেইলী রোডের একটি শাড়ির দোকানের ম্যানেজার শংকর দাস।

পহেলা বৈশাখে এমনিতেই বাঙালি ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে প্রাণের টানে। বরবারের মতেই এবারেও রমনার বটমূলে ছিল ছায়ানটের প্রভাতি সংগীতানুষ্ঠান। ‘শান্তি মানবতা ও মানুষের অধিকার’ শিরোনামে রমনার বটতলায় ছায়ানটের এই প্রভাতি গানের অনুষ্ঠান শুরু হয় ভোর ৬টা ১৫ মিনিটে।

শুরুতেই সেতারবাদন। এর মধ্য দিয়ে ছায়ানটের শিল্পীরা নতুন বছরকে স্বাগত জানান। এরপর চলে রবীন্দ্র সংগীত। শিল্পীদের সুরের মূর্ছনায় মুগ্ধ হন হাজারো শ্রোতা।

রমনার বটতলার এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে সংশ্লিষ্ট এলাকায় নেওয়া হয় কড়া নিরাপত্তা-ব্যবস্থা। নিরাপত্তা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্যদের সতর্ক অবস্থানে থাকতে দেখা যায়। রমনায় প্রবেশের ক্ষেত্রে করা হয় তল্লাশি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে  সকালে ঐতিহ্যবাহী মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। এবারের প্রতিপাদ্য ‘অনেক আলো জ্বালতে হবে মনের অন্ধকারে’।

অসাম্প্রদায়িক বাংলার মাটিতে উগ্রবাদী হামলায় লেখক অভিজিৎ রায় ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান খুন হওয়ার প্রেক্ষাপটে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে বেছে নেওয়া হয় এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য।

এই প্রেক্ষাপট নিয়েই শোভাযাত্রার প্রধান প্রতীকটি তৈরি করা হয়; প্রায় ২০ ফুট লম্বা মুষ্টিবদ্ধ হাত, যার আঙুলে রয়েছে লাল রং। এই বিশাল হাত গলা টিপে ধরেছে সাধারণ মানুষের।

প্রচণ্ড ভিড়, প্রখর রোদের মধ্যে অগণিত মানুষের কোলাহল, হর্ষধ্বনি, গান ও ঢাকঢোলের ঐকতানে মুখর হয়ে ওঠে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। সকাল থেকেই ধানমন্ডি লোকের পাশে রবীন্দ্রসরোবর মঞ্চকে কেন্দ্র করে বিপুল লোকসমাগম হয়।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সকাল আটটায় বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ পর্যন্ত মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ১০টায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দলের শীর্ষ নেতারা শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।

নববর্ষের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে  মঙ্গলবার রাজধানীর নয়াপল্টনে যান বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বিএনপির অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস) বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রাঙ্গণে ছিল নাচ, বাউল গানসহ আরও নানান পরিবেশনা। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর বর্ষবরণের অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল সাতটায়, বাসাবো বালুর মাঠে। সেখানে ছিল গীত, নৃত্য, আবৃত্তি, নাটক।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সকাল আটটা থেকে গান-কবিতায় বর্ষবরণ চলবে। জাতীয় প্রেস ক্লাব সদস্যদের জন্য ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।দিনভর ঐতিহ্যবাহী খাবারের সঙ্গে সদস্যদের জন্য নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতেও।

চ্যানেল আই ও সুরের ধারার আয়োজনের নাম ‘হাজার কণ্ঠে কোটি বাঙালির বর্ষবরণ ও বৈশাখী মেলা’। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠানের শুরু হয় সূর্যোদয় থেকেই।

কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার দিনভর আয়োজনের মধ্যে ছিল আলোচনাচক্র, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশুদের চিত্রাঙ্কন ও পিঠা মেলা। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সকাল আটটা থেকে দুপুর পর্যন্ত পান্তা-ইলিশ উৎসবের আয়োজন করে।

শাহবাগের শিশুপার্কের সামনে, রমনা পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে ছিল নানা অনুষ্ঠান। চারুকলা অনুষদ, শাহবাগ চত্বর, ছবির হাট চত্বর পরিণত হয় লোকারণ্যে

বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা আয়োজনে বাংলা নববর্ষকে বরণ করেছে। তবে টিএসসির সামনে, শহীদ মিনার চত্বরে, শাহবাগে, বেইলি রোড ও মিন্টোরোড, হেয়াররোডে দেখা যায় হাজার হাজার উৎসবমুখর মানুষ। বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকরাও বষর্বরণের অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

অধিকাংশ তরুণ তরুণীর হাতে ছিল প্লাস্টিকের তৈরি ভুভুজেলা বাঁশি। এই বাঁশির শব্দে সারা দিন সরব ছিল মহানগরীর পরিবেশ। অনেকের হাতে ছিল দেশের মানচিত্র খচিত মুক্তিযুদ্ধকালীন পতাকাও। কণ্ঠে ছিল নববর্ষের গান ‘এসো হে বৈশাখ’

কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। সারা দিনমান আনন্দময় সময় কাটিয়ে একটি শান্তিময় সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের প্রত্যাশা নিয়ে ঘরে ফিরেছেন নগরবাসী।

“পহেলা বৈশাখ নেহাত একটি বছরের শুরুর দিন নয় বাংলাভাষীদের কাছে। এটি এই জনপদের মানুষের সুদীর্ঘ কালের আপন সাংস্কৃতিক চেতনা ও ঐতিহ্যের স্মারক। আপন জাতিসত্তায় অনুপ্রাণিত উৎস,” বেনারকে জানান বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

ঐতিহাসিকদের মতে, বৈদিক যুগে বাংলা সনের প্রথম মাস ছিল অগ্রহায়ণ। সম্রাট আকবর ফসলি সন হিসেবে বৈশাখ মাসকে প্রথম ধরে বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করেন। বৈশাখ থেকে বাংলায় প্রথম খাজনা আদায় করা শুরু করেন নবাব মুর্শিদকুলি খান । জামিদারি আমলে পহেলা বৈশাখের প্রধান আয়োজন ছিল খাজনা আদায় উপলক্ষে ‘রাজ পুণ্যাহ’ ও ব্যবসায়ীদের ‘হালখাতা’।

জামিদারি প্রথা বিলোপের পর ‘রাজ পুণ্যাহ’ লুপ্ত হয়ে যায়। ব্যবসাবাণিজ্য, লেনদেনেও আসে পরিবর্তন। হালখাতাও জৌলুস হারিয়ে ফেলে।

ইদানীং নাগরিক জীবনে যে সাংস্কৃতিক চেতনায় পহেলা বৈশাখের উৎসব হচ্ছে, তা প্রবর্তনের কৃতিত্ব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তিনিই প্রথম শান্তিনিকেতনে ঋতুভিত্তিক উৎসবের আয়োজন করেন। এর অংশ হিসেবে বৈশাখ বরণের উৎসব আয়োজনের পাশাপাশি বাংলা নতুন বছরকে সম্ভাষণ জানিয়ে রচনা করেছেন বহু কালজয়ী সংগীত ও কবিতা।

“সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ থেকে ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐক্যবোধে উদ্দীপ্ত হওয়ার উপলক্ষও  পহেলা বৈশাখ। এ কারণেই এই উৎসবের গুরুত্ব দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়েছে,” বেনারকে জানান সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। চারুকলা ইনস্টিটিউটের  ঐতিহ্যবাহী মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেন তিনি ।

নববর্ষকে বাঙালি দেখে তার সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের অংশ হিসাবে। সারা বছর বাংলা তারিখের খোঁজ নেই, কিন্তু  এই দিন কোমর বেঁধে লেগে যায় দিনটা পালন করতে।

“নববর্ষ-উদ্‌যাপন এখন বাংলাদেশের প্রধানতম উৎসব। এর মধ্যে আমরা খুঁজে পাই আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, আমাদের স্বকীয়তা, আমাদের অস্তিত্বের শিকড়,” বেনারকে জানান  মাহতাব হোসেন, যিনি একজন ব্লগার এবং লেখালেখি করেন।

মাহতাব জানান, “যদিও আমরা বাংলাদেশীরা বাংলা সন-তারিখকে বাক্সবন্দী করে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ইংরেজী সন-তারিখকেই বরণ করে নিয়েছি, তবুও পহেলা বৈশাখ আমাদের মনে একটা ভিন্ন মাত্রার উদ্দীপনা, ভিন্ন মাত্রার আমেজ তৈরী করে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।