বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়লেও জঙ্গিবাদ দমন ও সুশাসন চান অর্থনীতিবিদরা

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.06.23
20160623-FDI-Story620.jpg সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদসহ বিভিন্ন কারণে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জুন ২০১৬
ফোকাস বাংলা

গত বছর বাংলাদেশে ২২৩ কোটি ডলারের সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগ ছিল বাংলাদেশে, প্রথম অবস্থানে ছিল ভারত।

জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা ইউনাইটেড ন্যাশন্স কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আঙ্কটাড) সর্বশেষ বৈশ্বিক বিনিয়োগ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গত বুধবার বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড এটি প্রকাশ করে।

বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান এস এ সামাদের সভাপতিত্বে আনুষ্ঠানিকভাবে আঙ্কটাডের প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম ইসমাইল হোসেন প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন।

এফডিআই বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে সরকার অর্থনীতির ‘সুবাতাস’ বললেও বিশ্লেষকেরা বলছেন, দেশে চলমান জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ সঠিকভাবে দমন করতে না পারলে আগামীতে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তবে কেউ কেউ জঙ্গিবাদের চেয়ে সুশাসনের অন্যান্য ইস্যুকে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে ১৫৫ কোটি ১০ লাখ ডলার এফডিআই এসেছিল। আর ২০১৫ তা ৪৪ শতাংশ বেড়ে ২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন হয়েছে।

আঙ্কটাডের ‘ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট-২০১৬’ বলছে, গত বছর দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে; তার মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এক্ষেত্রে ৪ হাজার ৪২০ কোটি ৮০ লাখ (৪৪ দশমিক ২০বিলিয়ন) ডলার বিনিয়োগ নিয়ে প্রথম অবস্থানে রয়েছে ভারত।

প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছর সারা বিশ্বে এফডিআই এসেছে ১ দশমিক ৭৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতির পর এটাই সর্বোচ্চ। এছাড়া ২০১৪ সালের এফডিআইয়ের তুলনায় ৩৮ শতাংশ বেশি।

একক দেশ হিসেবে ৩৮০ বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ পেয়ে প্রথম স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। হংকং ও চীন যথাক্রমে ১৭৫ বিলিয়ন ও ১৩৬ বিলিয়ন বিনিয়োগ করে তারপরের অবস্থানে রয়েছে।

কোন খাতে, কত বিনিয়োগ

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। এসব খাতে সর্বোচ্চ ৫৭ কোটি ৪০ লাখ ডলারের বিনিয়োগ এসেছে।

৪৪ কোটি ৩০ লাখ ডলারের বিনিয়োগ নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বস্ত্র ও পোশাক খাত। এছাড়া টেলিযোগাযোগে ২৫ কোটি, ব্যাংকিংয়ে ৩১ কোটি,  খাদ্য পণ্যে প্রায় সাড়ে ১২ কোটি এবং কৃষি ও মৎস্য খাতে দুই কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং অন্যান্য খাতে ৫০ কোটি ৩০ লাখ ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে।

ভাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিই কারণ

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হওয়ায় বিনিয়োগ বোর্ডকে অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। আর এর অন্যতম কারণ হিসেবে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ও ভাল নেতৃত্বকে চিহ্নিত করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, “ভালো নেতৃত্ব ও দেশে শান্তি থাকলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবেই। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিনিয়োগ পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। এর আগের বছরের মত হরতাল-অবরোধের মতো ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম সংঘঠিত হয়নি।”

“দেশে বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে। উন্নয়ন হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থারও। আর এসবের ফলেই প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নয়ন হচ্ছে,” জানান তৌফিক ইলাহী।

বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ায় বেসরকারি খাতও বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এর ফলে দেশে বিনিয়োগ খরা কেটে যাবে।

পুনঃবিনিয়োগই বেশি

বিদেশি বিনেয়োগের এ হিসেব প্রকৃত বিনিয়োগ নাকি এগ্রিমেন্টের হিসেব—তা নিয়ে প্রশ্ন রেখে বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই এফডিআইয়ের বেশির ভাগই পুনঃবিনিয়োগ। তাছাড়া দেশে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ নিয়েও শঙ্কা রয়েছে তাঁদের।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “প্রথমে দেখতে হবে এই বিদেশি বিনিয়োগ এগ্রিমেন্ট নাকি প্রকৃতই বিনিয়োগ হয়েছে। সত্যিকার বিনিয়োগ হয়ে থাকলে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু আশঙ্কার কথা হলো সার্বিকভাবে বেসরকারিভাবে বিনিয়োগ বাড়ছে না।”

অন্যান্য দেশের তুলনায় বিদেশি বিনিয়োগের এ পরিমাণ অনেক কম উল্লেখ করে তিনি বলেন, “পার্শ্ববর্তী অনেক দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আরো অনেক বেশি। তা ছাড়া এর বিরাট একটি অংশ পুনঃবিনিয়োগ। এ দেশে ইতিমধ্যে যারা বিনিয়োগ করেছেন, তারাই তাঁদের  লভ্যাংশ আবার বিনিয়োগ করছেন। এখানে নতুন আসা মূলধন অনেক কম।”

পলিসি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড. আহসান এইচ মনসুর বেনারকে বলেন, “এফডিআই বেড়েছে, তবে তা জাতীয় আয়ের মাত্র এক শতাংশ। অথচ আমাদের পাঁচ বছরের  লক্ষ্যমাত্রায় আগামী বছরের জন্য এফডিআই নির্ধারিত হয়েছে ১.৯ শতাংশ। তাই খুব যে বেড়েছে, তা বলা যাবে না।”

প্রতিবন্ধকতা দূর করার পরামর্শ

তবে এফডিআই প্রবাহের ধারা বজায় রাখতে সার্বিক সুশাসন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারসহ বিদ্যমান নানা প্রতিবন্ধকতা দূর করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।

এ প্রসঙ্গে মির্জ্জা আজিজ বলেন, “সাম্প্রতিক সন্ত্রাসবাদের উত্থান বিদেশিদের বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দেবে। ফলে বিনিয়োগের ইচ্ছে থেকে সরেও যেতে পারেন তাঁরা। তাই দেশে সুশাসন আনার পাশাপাশি সকল ধরনের উগ্রবাদকে সমূলে ধ্বংস করে বিদেশিদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।”

তবে জঙ্গিবাদকে প্রধান সমস্যা মনে করছেন না অনেকেই।

ড. আহসান এইচ মনসুর বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে যে মাত্রার জঙ্গিবাদ রয়েছে, তা গভীর উদ্বেগের বিষয় নয়। এ ধরনের জঙ্গিবাদ পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই রয়েছে।”

তাঁর মতে, জঙ্গিবাদের চেয়ে বিদেশি বিনিয়োগের প্রধান অন্তরায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ পাওয়া, জমির প্রাপ্যতা, অবকাঠামো, চাঁদাবাজি, আইনগত সমস্যাসহ সুশাসনের অন্যান্য অনেক ইস্যু।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।