বাংলাদেশ–ভারত ক্রিকেটযুদ্ধ নিয়ে বাকযুদ্ধ
2015.03.18
খেলার মাঠে বাংলাদেশ–ভারতের ক্রিকেট যুদ্ধের উত্তাপ দুই দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ক্রিকেট খেলার সময় দুই দেশের সংবাদপত্রের কমন শিরোণাম হয়, ‘এটা যুদ্ধ নয়, খেলা।’ কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষেত্রে এমনটি বলার সুযোগ নেই। আগামীকাল বৃহস্প্রতিবার ১৯ মার্চ এই খেলা অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের মাঠে অনুষ্ঠিত হবে।
অবশ্য বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে খেলা হলেও একথা বলা যেত। কারণ এখন স্বাধীনতার মাস, প্রতিরোধের মাস মার্চ। সামনে ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস। একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঝাপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র, নিরীহ বাঙালীদের ওপর।
ভারত ও বাংলাদেশ পাশাপাশি দেশ। ভারত বড় প্রতিবেশী, মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সহায়তাকারি, এটা ঐতিহাসিক সত্য।
কিন্তু খেলার মাঠে বাংলাদেশ–ভারতের ক্রিকেট যুদ্ধের উত্তাপ দুই দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। গত ১৬ মার্চ মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, তিনি ১৯ মার্চ খেলা দেখবেন। ওইদিন আনুষ্ঠানিক কোনো কর্মসূচী না রাখতে বলেছেন।
মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর একথা জানান।
“বাংলাদেশের খেলার সময় প্রধানমন্ত্রী অন্যরকম হয়ে যান। খেলা দেখেন মনোযোগ দিয়ে, আর দশজনের মতো নিকটজনের সঙ্গে খেলাধুলা নিয়ে আলোচনা করেন,” জানান আসাদুজ্জামান নূর।
শুধু কি প্রধানমন্ত্রী? প্রায় ১৬ কোটি মানুষের দেশে ক্রিকেট উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। এরই মধ্যে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০–দলীয় জোট ১৭ মার্চ হরতাল ঘোষণা করেছে। দেশের কোটি কোটি ক্রিকেটপ্রেমির প্রত্যাশা ছিল, বাংলাদেশ–ভারত খেলার দিন ২০–দলীয় জোট হরতাল দেওয়া থেকে বিরত থাকবে।
এর আগে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বিজয়ী হওয়ার পরদিন আনন্দ উদযাপনের জন্য বিএনপি হরতাল প্রত্যাহার করেছিল। কিন্তু সেই সুযোগ ১৯ মার্চ দেওয়া হয়নি।
গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে এ বছরের ৬ জানুয়ারি থেকে বিরোধী জোট অবরোধ, হরতাল করে যাচ্ছে। ১৭ মার্চ ছিল অবরোধের ৭১তম দিন।
চলমান রাজনৈতিক সংকটের মধ্যেও কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে পারার সাফল্যে খেলোয়াড়দের মতোই উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকরা।
সমর্থকদের অনেকের কাছেই ম্যাচটি এখন শুধুই খেলা নয়। এটা নিয়ে যুক্তিতর্ক, সমালোচনা ও তীর্যক মন্তব্য চলছে ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। এর মধ্যে ঢুকে পড়ছে তিস্তার পানিবন্টনসহ অমীমাংসিত বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুও।
বিষয়টি শুরু হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের অভিনেতা প্রসেনজিতের একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে কটাক্ষ করে ফেইসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। পরে এ নিয়ে ক্ষমা চাইলেও, পুরো বিষয়টি নিয়েই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারই নতুন সিনেমা ‘শঙ্খচিল’-এর কাহিনীকার সায়ন্তনি পুততুণ্ড।
প্রসেনজিতের স্ট্যাটাস, “বাঘ অনেক রকম হয়। বেড়ালকে বাঘ ভেবে যেন ভুল করো না।” এ থেকেই মূলত বিতর্কের সূত্রপাত। পরে এই স্ট্যাটাসকে নিজের অভিনীত ‘অমর প্রেম’ সিনেমার ডায়লগ বলে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন প্রসেনজিৎ।
প্রসেনজিৎ-এর এমন ব্যাখ্যাও খুব একটা মনঃপুত হয়নি সায়ন্তনির। তিনি লিখেছেন, ‘অমর প্রেম’ এর ডায়লগ হঠাৎ এখনই আপনার মনে পড়ল কেন? এখন তো অমরপ্রেম নয়, আপনি শঙ্খচিল এ ডুবে আছেন!
“বাংলাদেশের প্লেয়াররা বাঘ না বিড়াল, সেটা পরের কথা। আমার কাছে সবচেয়ে বড় কথা—ওরা বাঙালি।” জানান সায়ন্তনি।
প্রসেনজিৎ অবশ্য এর মধ্যেই বলেছেন, তার কোনো একটি ছবির ডায়ালগকে টাইগার সমর্থকরা ভুল বুঝেছে। এ নিয়ে দুঃখও প্রকাশ করেছেন তিনি। কিন্তু তাতে ক্ষোভ কমেনি বাংলাদেশী সমর্থকদের।
এদিকে খেলা নিয়ে বিতর্কের জের ধরে ভারতের সাংসদ ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী শশী থারুর ওয়েব সাইটটি হ্যাক করা হয়েছে।
“ধন্যবাদ বাংলাদেশ। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ভারতের বিশ্বকাপ সেমি ফাইনালে ওঠার রাস্তা সহজ করে দিলে তোমরা।” এই টুইটের পরই শশী থারুর ওয়েবসাইট হ্যাক করে প্রতিবাদ জানায় ‘ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার্স’।“ভারত নিজেদের ইতিহাস দেখুক, ২০০৭ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে হেরেই গ্রুপ লিগ থেকেই বিদায় নিয়েছিল তারা”, এই বক্তব্যও লিখেছে হ্যাকার গ্রুপ।
ফেসবুকে বাংলাদেশী সমর্থকদের সমালোচনায় বিদ্ধ হচ্ছেন সাবেক ভারতীয় ক্রিকেটার নভজ্যোৎ সিং সিধুও। তবে বাংলাদেশী সমর্থকদের অনেকটাই বিক্ষুব্ধ করেছে ইউটিউবে প্রচারিত ‘মওকা মওকা’ ভিডিওটি, যেখানে বিষয়টি এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যাতে সমর্থকদের অনেকের কাছে মনে হচ্ছে, ভারতই বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে।
জবাবে পাল্টা কিছু ভিডিও আপলোড করেছে বাংলাদেশের সমর্থকরা, যেখানে ভারতীয়দের পরাজয় দেখানো হয়েছে।
ভারতের বিজ্ঞাপনের স্লোগান যেখানে ‘উই ওন্ট গিভ ইট ব্যাক’, সেখানে বাংলাদেশি বিজ্ঞাপনের মূল বক্তব্য, ‘আমরা ২০০৭ ফিরিয়ে দেব৷’ ২০০৭ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার কুইন্স পার্ক ওভালে ভারতকে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশ দল।
কী আছে এই ভিডিওতে? দেখা যাচ্ছে, চাঁদের একটি গর্ত থেকে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে পড়ছে এক ভিনদেশী প্রাণী৷ সেটিই বাংলাদেশের প্রতিনিধি এই ভিডিওতে৷ সে ইচ্ছেমতো আছড়ে ফেলছে স্কটল্যান্ড, ইংল্যান্ড, আফগানিস্তানের মহাকাশচারীদের৷ ধ্বংসাত্মক ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে এগোচ্ছে সেই ভয়ঙ্কর জীব৷
হঠাৎ দেখা যায়, একটি পাথরের আড়ালে লুকিয়ে ভয়ে কাঁপছে ভারতীয় মহাকাশচারী৷ শেষ আটের ম্যাচে নামার আগে বাংলাদেশিদের কাছে ম্যাচটা এ রকমই৷ ইংল্যান্ডকে হারানোর পর যেন তাদের ভয়ে কাঁপছে ধোনি-বাহিনীও৷ শেষে ফুটে উঠছে ওই পাঁচটি শব্দ— ‘উই উইল গিভ ব্যাক ২০০৭’!
বিশ্বকাপে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের শুভ কামনা জানিয়ে আজ বুধবার (১৮ মার্চ) বিকাল ৪টায় পতাকা শোভাযাত্রা করার ঘোষণা দিয়েছে ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট ফ্যানস ইউনিটি’ নামের একটি সংগঠন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে বের হয়ে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় যাবে এ শোভাযাত্রা।
“আজ সকাল থেকেই আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাষ্কর্য, স্বেপার্জিত স্বাধীনতাসহ টিএসসি এলাকায় অবস্থান নিয়ে গানে-স্লোগানে মুখরিত রাখব। আজ যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলছে, তখন আমরা ঘরে বসে থাকি কি করে?” জানান আয়োজক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীবন এস চক্রবর্তী।