ছিটমহলে যৌথ জনগণনা শুরু হয়েছে

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.07.07
BD-Ind দুদেশের ভেতরে থাকা ১৬২টি ছিটমহলে সোমবার থেকে যৌথ জনগণনা শুরু হয়েছে। ৭ জুলাই,২০১৫
বেনার নিউজ

আগামী ৩১ জুলাই মধ্যরাত থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্থল সীমানা চুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় শুরু হবে। এই প্রেক্ষাপটে চুক্তি অনুযায়ী দুদেশের ভেতরে থাকা ১৬২টি ছিটমহলে সোমবার থেকে যৌথ জনগণনা শুরু হয়েছে। আগামী ১৬ জুলাই পর্যন্ত চলা এ জরিপে জনগণনার পাশাপাশি ছিটমহলের বাসিন্দারা কে কোন দেশের নাগরিক হতে চান সেই তথ্যও সংগ্রহ করা হচ্ছে।

যৌথ গণনার প্রথম দিনে বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দাদের বিরাট অংশই বাংলাদেশে থাকতে চান।

ছিটমহলবাসীর নাগরিকত্ব নির্ধারণ ছাড়াও ছিটমহলে ঘরবাড়ি, ভোগদখলকৃত জমি, অর্থসম্পদ ও আর্থসামাজিক অবস্থার একটি পূর্ণাঙ্গ হিসাব তৈরি করা এ গণনার লক্ষ্য। ভারতে বাংলাদেশের ৫১টি এবং বাংলাদেশে ভারতীয় ১১১টি ছিটমহল রয়েছে। উভয় দেশের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত ৭৫টি দল এই গণনা কার্য্ক্রম পরিচালনা করছে। প্রতি দলে একজন করে বাংলাদেশি ও ভারতীয় গণনাকারী রয়েছেন। এছাড়া দুদেশেরই একজন করে সুপারভাইজার আছেন। গণনার সময় ছিটমহলবাসীরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী কোনো দেশের নাগরিকত্ব নিতে চাইলে তা অবশ্যই ফরমে উল্লেখ করতে বলা হচ্ছে।


গণনা চলছে উৎসবের আমেজে

এর আগে সর্বশেষ ছিটমহলের জনগণনা করা হয় ২০১১ সালে।
সেই গণনা অনুযায়ী ভারতে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলে রয়েছে ১৪ হাজার ২২১ জন বাংলাদেশি। আর বাংলাদেশে ১১১টি ভারতের ছিটমহলে রয়েছে ৩৭ হাজার ৩৬৯ জন ভারতীয়।

ছিটমহলবাসী বেশ উৎসবের আমেজে গণনায় অংশ নিচ্ছেন। তবে বাংলাদেশের ভেতর ৪৩টি ও ভারতের ভেতর ২০টি ছিটমহলে কোন জনবসতি নেই। শুধু সেখানকার জমিগুলো জরিপের আওতায় আসছে।
এদিকে যৌথ গণনা শুরুর পর বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত ভারতের ১১১টি ছিটমহলের বাসিন্দাদের ৯০ শতাংশই বাংলাদেশে থাকতে চান।

এ ব্যাপারে হাতীবান্ধা উপজেলা পরিসংখ্যান কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “এবারের জরিপের মূল উদ্দেশ্য ছিটমহলের বাসিন্দারা কে কোন দেশের নাগরিকত্ব পেতে চান সেই তথ্যও সংগ্রহ করা। জরিপে বেশিরভাগ ছিটবাসীদের বাংলাদেশে থাকার পক্ষেই মত পাওয়া যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দাদের মধ্যে কেউ নাগরিকত্ব পেতে ভারতে যেতে চাইলে তার ছবি তুলে রাখা হচ্ছে।”


অধিকাংশ ছিটবাসী বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকতে চান

স্থানীয় বাসিন্দারাও বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে বসবাস করতে চান। তবে সংখ্যালঘুরা ভারতে যাওয়ার পক্ষে।

পাটগ্রামের ২০ নম্বর লতামারী ছিটমহলের বাসিন্দা আবুল খায়ের বলেন, “এতদিন ভারতের অংশ ছিলাম ঠিকই। কিন্তু ৬৮ বছরে ধরে সে ছিল বন্দীজীবন। সেই বন্দিত্বের মধ্যে থেকেও বাংলাদেশের সুবিধা নিয়েছি। সেই থেকে মনে প্রাণে আমরা বাংলাদেশি হয়ে গেছি। তাছাড়া এখানে বাস করতে করতে আমরা একে অপরের ভাই হয়ে গেছি। এই ভাইদের ছেড়ে ভারতে যাওয়ার কথা ভাবতে পারিনা”।

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অভ্যন্তরে অবস্থিত দেশের সবচেয়ে বড় ছিটমহল দাশিয়ার ছড়ার ফুলবানু বিবি বলেন, “এখানকার মাটিতেই জন্ম নিয়েছি, এ মাটিতেই মরতে চাই”।

দ্বিতীয় দিনের যৌথ জরিপের পর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, ‘জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে ছিটমহলের প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ বাসিন্দা বাংলাদেশের ভুখন্ডে থাকতে চাইছেন। এ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হল, অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশিরা ভারতে অনুপ্রবেশ করে বলে ভারতের অভিযোগ যথার্থ নয়। কেননা ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দারাই নিজেদের নাগরিকত্ব ছেড়ে বাংলাদেশে থেকে যেতে চাইছেন। কিন্তু তারা ভারতের নাগরিকত্ব নিলে সহজেই অর্থনৈতিক সুবিধা নিতে পারেন। ভারত সরকার তাদের পুনর্বাসনের জন্য বিরাট অর্থ বরাদ্দ রেখেছে। কিন্তু সেই সুযোগ তাদের অধিকাংশই গ্রহণ করছেন না।”

এদিকে, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বেনারকে বলেন, “ছিটমহলবাসীদের শনাক্তের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুততম সময়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট দেওয়া হবে। তাদের জীবনে এটারই সবচেয়ে আগে প্রয়োজন। ছিটমহলবাসীদের জন্য এবারের বাজেটে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রয়োজনে তা বাড়ানো হবে”।

অন্যদিকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারকে ছিটমহলবাসীদের পুনর্বাসনে বিপুল বরাদ্দ দিয়েছে।


সম্পদ বিক্রি করে ভূখন্ড বদল করতে পারবে

সরকারি সূত্রে জানা গেছে, ছিটের যে সকল বাসিন্দা ভারত ছেড়ে বাংলাদেশ অথবা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারত যাবেন, তারা টাকা-পয়সাসহ অস্থাবর সম্পত্তি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবেন। আগ্রহী ব্যক্তিকে আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে ভারতের অথবা বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে চলে যেতে হবে। তবে যদি কোনো ব্যক্তি ৩০ নভেম্বরের আগে স্থাবর সম্পত্তি রেখে ভারতে অথবা বাংলাদেশে যেতে চান, সে ক্ষেত্রে সম্পত্তির দলিলের কপি স্থানীয় জেলা প্রশাসনের হেফাজতে রেখে যেতে পারবেন।

আগামী ২০ জুলাই এই যৌথ জনগণনার ফলাফল প্রকাশিত হবে।
২০১১ সালের পর এসব ছিটমহলে কত শিশু জন্মগ্রহণ করেছে, কতজন মারা গেছেন তার তালিকা করা হবে নতুন গণনায়।

সম্প্রতি ভারতের লোকসভায় সর্বসম্মতভাবে দীর্ঘপ্রতীক্ষিত বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমান্ত চুক্তি ১৯৭৪ এবং প্রটোকল- ২০১১ পাস হয়। এরপর গত ৬ জুন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরকালে ওই চুক্তির দলিল হস্তান্তর হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।