বেসরকারি সংস্থার বৈদেশিক অনুদান গ্রহণ কঠোর শর্তের বেড়াজালে

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.10.07
20161007-BD-NGO-bill20161000.jpg জাতীয় সংসদে বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন বিল, ২০১৬ পাস করা হয়। অক্টোবর ০৬, ২০১৬।
ইয়াসিন কবির জয়

সংবিধান ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ‘বিদ্বেষমূলক’ বা ‘অশালীন’ বক্তব্য দিলে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থা বা এনজিওর নিবন্ধন বাতিল করা যাবে। এটা রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

গত বুধবার জাতীয় সংসদে পাস হওয়া বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন বিলে এ কথা বলা হয়েছে, যা রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেলে আইনে পরিণত হবে। বিলটি পাস হওয়ার পর কড়া সমালোচনা করছে মানবাধিকার সংগঠন ও বেসরকারি সংস্থাগুলো।

বলা হচ্ছে, যেসব এনজিও মানবাধিকার, দুর্নীতি এবং সুশাসন নিয়ে কাজ করে তাদের জন্য পরিস্থিতি কঠিন হবে। নতুন এই আইন বাক স্বাধীনতা রুদ্ধ করতে পারে। সামগ্রিকভাবে এটা সহায়তামূলক না হয়ে নিয়ন্ত্রণমূলক হওয়ার আশংকা করা হচ্ছে।

গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে বিলটি উত্থাপন করেন মতিয়া চৌধুরী। এর কয়েক দিন পর টিআইবির ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সংসদকে ‘পুতুলনাচের নাট্যশালা’ বলে মন্তব্য করেন।

এই মন্তব্যকে ঘিরে সংসদে সমালোচনার ঝড় ওঠে। আইন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি টিআইবিকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানায়।

মন্তব্যের পর সংসদীয় কমিটি বিলে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ‘কটাক্ষমূলক মন্তব্য ও অপরাধ’-সম্পর্কিত এই বিধান যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়।

বিলটি পাস হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় ড. ইফতেখারুজ্জামান বেনারকে বলেন, “বিষয়টি হতাশাব্যঞ্জক। তাঁর মতে, ‘অশোভন’, ‘অশালীন’ বা ‘বিদ্বেষমূলক’—এ জাতীয় শব্দগুলো ব্যাপকভাবে ব্যাখ্যা বা অপ-ব্যাখ্যার সুযোগ আছে।”

তিনি আরও বলেন, “মন্তব্য করা যদি ফৌজদারি অপরাধ হয়, তাহলে তা আইনের খারাপ দৃষ্টান্ত হবে।” তাঁর মতে, এই আইন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং গণতন্ত্রের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই আইনটির লক্ষ্য এনজিও ব্যুরোকে শক্তিশালী করা, এর নজরদারি ক্ষমতা বাড়ানো। আরও লক্ষ্য সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন বন্ধ করা।

আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কীত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত বেনারকে বলেন, জাতীয় সংসদ সম্পর্কে টিআইবি খুবই আপত্তিকর মন্তব্য করেছিল। এভাবে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে গালি দেওয়া যায় না। আইনটির মাধ্যমে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম সম্পর্কে কথা বলা বা সমালোচনা করা যাবে কিনা—এ প্রসঙ্গে সুরঞ্জিত বলেন, “অনিয়মের সমালোচনা করা যাবে, কিন্তু অবমাননা করা যাবে না। আর তা করলে অস্তিত্বে টান পড়বে।”

তবে আইনজ্ঞরা মনে করছেন, নতুন এই আইনে এনজিওগুলো চাপ অনুভব করবে এবং সরকারের বা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সমালোচনার ক্ষেত্রে তারা সতর্ক হয়ে যাবে।

সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বেনারকে বলেন, “নতুন এই আইন বাক স্বাধীনতা ও নাগরিকের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন করবে। এ ধরণের আইন করা থেকে বোঝা যায় যে, সরকার সমালোচনা সহ্য করতে চায় না, যেটা গণতন্ত্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”

ফেডারেশন অব এনজিওস ইন বাংলাদেশের (এফএনবি) পরিচালক তাজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “দেশের বেসরকারি সংস্থাগুলো উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারের সম্পূরক হিসেবে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের অংশীদার হয়ে কাজ করে থাকে। সেখানে সংবিধান ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিদ্বেষমূলক বা অশালীন বক্তব্য দেওয়া বা রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড করার প্রশ্নই আসে না। তাই এ নিয়ে মন্তব্য করারও কিছু নেই।”

অনুদান গ্রহণে কড়াকড়ি

সংসদে পাস হওয়া বিলে বলা হয়েছে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে নিষিদ্ধঘোষিত বা তালিকাভুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বৈদেশিক অনুদান গ্রহণ করতে পারবে না। বিদেশ থেকে পাওয়া অনুদান যেকোনো তফসিলি ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান নারী, শিশু, মাদক ও অস্ত্র পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এসব ক্ষেত্রে এনজিও ব্যুরো সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাসহ নিবন্ধন বাতিল করতে পারবে।

এনজিওতে বিদেশি উপদেষ্টা নিয়োগের ক্ষেত্রেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা ছাড় নিতে হবে। বিদেশি অনুদান একটি নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসাবে (মাদার অ্যাকাউন্ট) থাকতে হবে। ব্যয়ের হিসাব অডিট করার পর এনজিও-বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালকের কাছে দিতে হবে। এনজিও-বিষয়ক ব্যুরো এসব বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কার্যক্রম পরিদর্শন, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করবে।

বিলে আরও বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থী, সাংসদ, স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দল, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি, সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা বা কর্মচারী, এ আইনের অধীন নিবন্ধিত এনজিও বা সংস্থার কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী বৈদেশিক অনুদান গ্রহণ করতে পারবে না।

ব্যক্তিকে জড়ানো হয়েছে

বিলে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের জন্য বিদেশ থেকে কোনও ধরনের অনুদান আনতে চাইলে এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর অনুমতি নিতে হবে। সন্ত্রাসীকাজে অর্থায়ন বন্ধের বিষয়টি মাথায় রেখে এটা করা হলেও তা স্বেচ্ছাসেবামূলক বা চ্যারিটি কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে বেসরকারি খাত সংশ্লিষ্টদের মত।

“আমি মনে করি, বিলে বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে ব্যক্তিকে যুক্ত করা উচিত হয়নি। এতে স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের জন্য ব্যক্তির মাধ্যমে অনুদান আসার প্রবাহ একদিকে কমতে পারে, অন্যদিকে বাড়তে পারে ব্যাংকের বাইরে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোর প্রবণতা,” বেনারকে জানান গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী।

তাঁর মতে, এ দেশের ঐতিহ্য হচ্ছে বিদেশ থেকে আর্থিক অনুদান এনে তা সেবামূলক কাজে খরচ করা। এই অনুদান বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমেই আসে। বিভিন্ন সেবামূলক কাজ, বৃত্তি, যাকাত, মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসাসহ বিভিন্নখাতে এই অনুদান আসে। এখন এনজিও ব্যুরোর অনুমোদন নেওয়ার বিধান চালু করায় মানুষ ঝামেলা এড়াতে এসব অনুদান লেনদেন করতে চাইবে না।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী মনে করেন, বৈদেশিক অনুদান এনে স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ করতে চাইলে বেসরকারি সংস্থার এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধন নেওয়ার বিষয়টি সমর্থনযোগ্য। কিন্তু ব্যক্তিকে জড়ানো ঠিক হয়নি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।