নিজামীর ফাঁসির প্রতিবাদে ঢাকা থেকে রাষ্ট্রদূত ফিরিয়ে নিল তুরস্ক

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ ও জেসমিন পাপড়ি
2016.05.12
Turke-Ambassador620.jpg ঢাকায় তুরস্কের রাষ্ট্রদূত ডেভরিম ওসতুর্ক । ফাইল ফটো
ফোকাস বাংলা

জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসি দেওয়ার প্রতিবাদে তুরস্ক সরকার ঢাকা থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতক ফিরিয়ে নিয়েছে। বৃহস্পতিবার বার্তা সংস্থা রয়টার্স এই খবর দেওয়ার পর বাংলাদেশ এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

বাংলাদেশ বলছে, রাষ্ট্রদূত স্বাভাবিকভাবেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে দেশের বাইরে গেছেন। তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহারের কথা জানায়নি।

“রয়টার্সের প্রতিবেদন আমরা দেখেছি। এর সত্যতা জানা নেই। নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেশের বাইরে যাওয়ার কথা অবগত করেছেন। তাঁর অবর্তমানে কে দায়িত্ব পালন করবেন, সেটিও জানিয়ে গেছেন। এর বাইরে কিছু জানা নেই,” বেনারকে জানান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।

এদিকে রয়টার্সের খবরে বলা হয়, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেসেপ তায়েপ এরদোয়ান বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠানোর বিষয়টি জানিয়েছেন।

জামায়াতের পক্ষ নিয়ে পাকিস্তানের মতো তুরস্কও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করে আসছে। ঢাকায় নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর এর নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয় তুরস্ক ও পাকিস্তান।

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা ও পাকিস্তান বৃহস্পতিবার একে অপরের হাইকমিশনারকে তলব করেছে। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুকে কেন্দ্র করে টানাপোড়েন চলছে।

গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের আমির নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হয়।

রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নিল তুরস্ক

এদিকে তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাডলুর খবরে বলা হয়, নিজামীর ফাঁসি পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য ঢাকা থেকে রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠায় দেশটি।

তুরস্কের রাষ্ট্রদূত ডেভরিম ওসতুর্ক ২০১৫ সাল থেকে ঢাকায় দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বৃহস্পতিবার সকালেই রাষ্ট্রদূত ঢাকা থেকে টার্কিশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ঢাকা ছেড়েছেন বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিশ্চিত হয়েছে।

গত ১১মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো একটি ই-মেইল বার্তায় তিনি ঢাকা ছাড়ার কথা জানান।

ঢাকায় নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের পর নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয় তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ফাঁসির প্রতিবাদে ওই দেশটিতে বিক্ষোভ–সমাবেশ হওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে।

দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, নিজামীর এ ধরনের শাস্তি প্রাপ্য ছিল বলে মনে করে না তুরস্ক।

“আমরা বিশ্বাস করি তুরস্কের সঙ্গে আমাদের যে সুসম্পর্ক, বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন বিষয়কে কেন্দ্র করে তাতে ছেদ পড়বে না,” জানান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “কোনো দেশ থেকে কূটনীতিককে প্রত্যাহার করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট দেশকে আগে জানানোর কথা। তুরস্ক বাংলাদেশ সরকারকে এমন কিছু জানায়নি।”

ঢাকায় পাকিস্তানি দূতকে তলব

নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার নিন্দা জানিয়ে পাকিস্তানের পার্লামেন্ট বুধবার নিন্দা প্রস্তাব পাস করে। এতে বাংলাদেশের এই ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার’ প্রতি দৃষ্টি দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে ক্ষোভ জানিয়ে পাকিস্তান জামায়াতের আমির সিরাজ-উল হক বলেন, “পাকিস্তানের প্রতি ভালোবাসার কারণেই তাকে (নিজামী) ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে।”

অন্যদিকে পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে দাবি করা হয়, ‘ত্রুটিপূর্ণ বিচারে’ মৃত্যদণ্ড দেওয়া হয়েছে জামায়াত আমিরকে।

পাকিস্তান এই বিবৃতি দেওয়ার পর থেকে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকায় পাকিস্তানের হাই কমিশনার সুজা আলমকে ডেকে পাকিস্তানের এই অবস্থানের নিন্দা জানায়।

এর জবাবে বৃহস্পতিবার পাকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার নাজমুল হুদাকে তলব করে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (দ্বিপাক্ষিক ও কনস্যুলার) মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “পাকিস্তানের বিবৃতি এবং দেশটির নিন্দা গ্রহণযোগ্য নয়।আমরা পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে ডেকে কড়া ভাষায় এর প্রতিবাদ জানিয়েছি।”

মিজানুর রহমান পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়ার নিন্দা জানিয়ে সূজা আলমের হাতে বাংলাদেশের একটি প্রতিবাদপত্র তুলে দেন।

এতে বলা হয়, “১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার মতো অপরাধে দণ্ডিতদের পক্ষ নিয়ে পাকিস্তান সেইসব অপরাধে তাদের সম্পৃক্ততারই প্রমাণ দিচ্ছে।”

অবশ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সুজা আলম সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আগের মতোই থাকবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

এসময় এক দেশ আরেক দেশের রাষ্ট্রদূতকে বারবার তলব করার বিষয়টি কতটা শোভনীয় তা জানতে চাইলে হাইকমিশনার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও জোরদার হবে।”

“বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়টিতে নাক না গলাতে ঢাকার পক্ষ থেকে বারবার আহ্বান জানানো হলেও ইসলামাবাদ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছে। এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই,” বেনারকে জানান একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির।

তিনি বলেন, এর আগে জামায়াতের নেতা আলী আহসান মো. মুজাহিদ, আব্দুল কাদের মোল্লা ও মো. কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সময়ও একই প্রতিক্রিয়া এসেছিল পাকিস্তান থেকে। তবে এবার তারা আরও খোলসা করে বলেছে যে, নিজামী পাকিস্তানের সংবিধান ও আইন সমুন্নত রাখতে চেয়েছিল।

’৭৪-এর চুক্তি নিয়ে পাকিস্তান মিথ্যাচার করছে বলেও জানান লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির।

পাকিস্তান সব সময়ই নির্লজ্জ মিথ্যাচারে লিপ্ত বলে মন্তব্য করেছেন সরকারি দল আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের অপকর্মের সহযোগী ছিল নিজামীদের মতো দোসরেরা।

হানিফ বলেন, “ফের যদি তারা এই ধরনের দুঃসাহস দেখায় তবে দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক আমরা রাখব কি না তা বাংলার জনগণ ভেবে দেখবে।”

 

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।