সুদৃঢ় হচ্ছে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক
2016.09.19

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কে এক ধরনের টানাপোড়েন শুরু হয়। কোনোরকম রাখঢাক না করেই নির্বাচনের একদিন পর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে জানিয়ে দিয়েছিল, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন তাদের ‘হতাশ’ করেছে।
তবে দু’বছরের মাথায় এসে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার ক্ষেত্র অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে মার্শা বার্নিকাট গত ২১ জুলাই বলেন, “বাংলাদেশ দখল করা, নিয়ন্ত্রণ করা বা বাংলাদেশকে যুদ্ধক্ষেত্র বানানোর কোনো পরিকল্পনাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেই।”
গত ১৫ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক উপসহকারী মন্ত্রী মন প্রীত সিং আনন্দ লিন্ডন বি. জনসন স্কুল অফ পাবলিক অ্যাফেয়ার্সে দেওয়া এক বক্তৃতায় বলেন, “গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্কের কারণে গোটা বিশ্ব বেশ কিছু ক্ষেত্রে চমকপ্রদ উন্নয়ন হতে দেখেছে।”
এর আগে গত ২৯ আগস্ট মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ঢাকায় কয়েকঘন্টার সফর শেষে কেনেডি সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন, শ্রমিক ও নারীদের অধিকার সংরক্ষণসহ বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে কাজ করছে।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন সহায়তা সংস্থা ইউএসএইডের ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, ২০০১ সালে বাংলাদেশে মার্কিন সহায়তার পরিমাণ ছিল ১৩ কোটি ৫৮ লাখ ৬ হাজার ২১৯ মার্কিন ডলার। ২০১০ সালে এ সহযোগিতার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬ কোটি ৯১ লাখ ৫৫ হাজার ২৯৩ কোটি ইউএস ডলারে। গত বছর এ সহযোগিতার পরিমাণ ছিল ২০ কোটি ৬০ লাখ ৫ হাজার ৫৪৫ মার্কিন ডলার।
“অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো—এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়,” বেনারকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শেখ শামস।
তিনি জানান, “একটা সময় আমরা পত্রপত্রিকায় দেখছিলাম, মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চেয়ে পাচ্ছেন না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো বৈরী সম্পর্কে না যেয়ে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতেই আগ্রহ দেখাচ্ছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক মনে করেন, অবস্থানগত কারণে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে পাশে রাখতে চায়। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের অবস্থান সংহত রাখতেই বাংলাদেশের সমর্থন দরকার হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, “নিজেদের অর্থায়নে বাংলাদেশ যখন পদ্মা সেতুর কাজে হাত দেয় তখন গোটা বিশ্ব আসলে বুঝে নিয়েছে বাংলাদেশকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। বরং বন্ধুভাবাপন্ন সম্পর্ক থাকাটা সবার জন্য লাভজনক”।
যেসব ক্ষেত্রে সহযোগিতা
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউএসএইডের একজন কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, সংস্থাটি অর্থ ব্যয় করছে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের শিশুদের জন্য জনপ্রিয় শিক্ষামূলক ধারাবাহিক কার্টুন সিসেম স্ট্রিটের আদলে তৈরি ‘সিসিমপুর’ প্রচার থেকে শুরু করে জঙ্গিবাদ দমন বিষয়ক মতবিনিময় ও প্রশিক্ষণ কর্মশালায়।
ওই কর্মকর্তা বলেন, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের কর্মমুখী শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়নে পুকুরে মাছ চাষের প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ নানা কাজে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন যুক্ত।
সহযোগিতার প্রধান খাতগুলো হচ্ছে খাদ্য ও কৃষি, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসন, শিক্ষা, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন, জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন ও স্বাস্থ্য খাত। তবে খাদ্য ও কৃষি খাতে মার্কিন সহায়তা যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হামিদুর রহমান বেনারকে বলেন, “পাঁচ বছর আগেও খাদ্য ও কৃষি খাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তেমন অংশগ্রহণ ছিল না। এখন কৃষি খাতে বিভিন্ন নীতি সহায়তা থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ে কৃষকদের কাছে সেবা পৌঁছে দিতে ইউএসএইড স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে কাজ করছে।”
খাদ্য ও কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে সহায়তা করছে যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ইউএসএইড। ছবিঃ ইউএসএইড, ঢাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা আহসানিয়া মিশনের সহযোগিতায় দেশের ১২টি জেলায় একটি দিশারি প্রকল্প চলছে। ওই প্রকল্পের আওতায় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় বহু মানুষের সমাগম হয় এমন একটি জায়গায় বসেন। তিনি কৃষকদের কাছ থেকে তাঁদের সমস্যার কথা শোনেন। প্রয়োজনীয় সমাধান দেন। সমাধান দিতে না পারলে ঊর্ধ্বতন কারও কাছে পাঠিয়ে দেন। এ ছাড়া মুঠোফোনে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগর সুযোগ আছে, জরুরি প্রয়োজনে তাঁরা মোটর সাইকেলে করে মাঠে পৌঁছাচ্ছেন। এই সব সহায়তাই দিচ্ছে ইউএসএইড।
এর বাইরেও বাংলাদেশে ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইরি) ও ইফপ্রির কাজে ইউএসএইড সহযোগিতা দেয়। ফিড দ্য ফিউচার নামের একটি প্রকল্পের আওতায় কৃষকদের ভালো বীজ ব্যবহার, নিয়ন্ত্রিত সার ব্যবহার, সেচ দেওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে জানানো হচ্ছে।
২০১৪ সালে ১৭ লাখ কৃষক এ সম্পর্কিত তথ্য পেয়েছেন, হাতে–কলমে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন সাড়ে ৫ লাখ কৃষক। শুধু কৃষক নন, মৎস্য খামারিদেরও নানামুখী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে ইউএসএইড।
খাদ্য ও কৃষি খাতে জোর দেওয়ার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে পুষ্টি। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইসিডিডিআরবি) জ্যেষ্ঠ গবেষক তাহমিদ আহমেদ বেনারকে বলেন, “পুষ্টিকে স্বাস্থ্যের মূল ধারায় নিয়ে আসতে নীতিসহায়তা দিয়েছে ইউএসএইড। এর পাশাপাশি জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধান উৎপাদনে মাঠ পর্যায়ে সংস্থাটি কাজ করছে।”
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। ভাতের মাধ্যমে যেন জিঙ্কের চাহিদা অনেকটাই পূরণ করা যায় সে জন্যই এই কাজটি চলছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়।
এ ছাড়া জন্মের পর ছয় মাস পর্যন্ত শিশুদের শুধুমাত্র মায়ের দুধ খাওয়ানো, ভিটামিন ও খনিজ সরবরাহে অর্থায়ন করছে উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইউএসএইড।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১৪ সালে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ২০০ স্থানীয় সরকার ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এমনকি দলে ও দেশে দায়িত্বশীল রাজনৈতিক ভূমিকা কীভাবে পালন করা যাবে সে সম্পর্কে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ১৮ হাজার কর্মী। শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদেরও শ্রম আইনসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ওই একই বছরে।
শিক্ষা খাতে প্রশিক্ষণ পেয়েছে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ের ৭৬ হাজার শিক্ষার্থী ও প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়ুয়া ৮৬ হাজার শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন যথাযথভাবে করতে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন আরও প্রায় এক হাজার শিক্ষক।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক উপসহকারী মন্ত্রী চমকপ্রদ উন্নয়নের কথা বলেন। ইউএসএইড ও বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন সূত্র বলছে, চমকপ্রদ উন্নয়নের এই তালিকার শীর্ষে আছে মা ও শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়নে সহযোগিতা। ২০১৪ সালে ইউএসএইডের আর্থিক সহযোগিতায় সাড়ে ৩শ এনজিও ক্লিনিক, নয় হাজার ভ্রাম্যমাণ ক্লিনিক পরিচালিত হয়।
পরিবার পরিকল্পনা খাতে যে সেবা দেওয়া হয় তার প্রায় ৩৫ শতাংশ এখন আসছে ইউএসএইডের মাধ্যমে। সম্প্রতি ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা নির্মূলেও যুক্ত হয়েছে উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানটি।
জঙ্গিবাদ দমনে পারস্পরিক সহযোগিতা
উন্নয়নমূলক খাতের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন ধর্মীয় উগ্রবাদ দমনেও বাংলাদেশের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে চাইছে।
জন কেরি তাঁর সফর পরবর্তী সময়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পরিষ্কারভাবে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁদের কথাবার্তা হয়েছে। চলমান সহযোগিতার পাশাপাশি ‘অতিরিক্ত পদক্ষেপ’ কি নেওয়া যেতে পারে তা বিবেচনা করা হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে কেরি বলেন, “গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে আরও বেশি সহযোগিতার কথা ভাবা হচ্ছে। এরই মধ্যে কমিউনিটি পুলিশিং, মাদ্রাসা ছাত্রদের জন্য কাজের সংস্থান ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় কাজ চলছে।”
উল্লেখ, ২০১৫ সাল থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভিন্ন মতাবলম্বীদের খুনের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং পাশাপাশি সহযোগিতার প্রস্তাবও দিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় কমপক্ষে দুটি খুনের ঘটনায় এফবিআই সরাসরি সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশের পুলিশকে। মার্কিন নাগরিক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ড ও ইউএসএইডের কর্মকর্তা জুলহাস মান্নান এবং তাঁর বন্ধু মাহবুব রাব্বী তনয় খুনের তদন্তে এফবিআই প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দেয়।