গ্রামীণ অর্থনীতিতে পুরুষের চেয়ে বেশি অবদান রেখেও 'স্বীকৃতি নেই' নারীর

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.10.27
161027-BD-Village-Women1000.jpg ঢাকার অদূরে মুন্সিগঞ্জের একটি গ্রামে আলু ক্ষেতে কাজ করছেন নারী শ্রমিকেরা। মার্চ ১৩, ২০১৬।
নিউজরুম ফটো।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে পুরুষের চেয়ে বেশি অবদান রেখেও রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো স্বীকৃতি নেই বাংলাদেশের নারী কৃষকদের। বিদ্যমান সমাজ কাঠামো, প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কৃষিতে নারীর অবদানকে অবহেলা করার সাধারণ প্রবণতাকেই এর জন্য দায়ী করেছেন বিশ্লেষকেরা।

তাঁরা বলছেন, নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে কৃষিতে নারীর অবদানের মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি প্রদানের পাশাপাশি ভূমিতে সমধিকার এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় নারীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

নারীর অবদান ৫৩ শতাংশ

এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অবদান ৫৩ শতাংশ, যেখানে পুরুষের অবদান মাত্র ৪৭ শতাংশ। তারপরও নারী কৃষকদের রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো স্বীকৃতি নেই।

এমনকি ২০১৫ সালে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার অংশ হিসেবে যে ১ কোটি ৩৯ লাখ কৃষক কার্ড বিতরণ করা হয়েছিল, তার একটিও ভাগ্যে জোটেনি নারী কৃষকদের। বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ।

‘কৃষিতে নারীর অবদানের মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি প্রদান, ভূমিতে নারীর সমধিকার এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় নারীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা হোক’ শীর্ষক এই সংবাদ সম্মেলনে নারী মৈত্রীর নির্বাহী পরিচালক শাহিন আকতার মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন।

তাঁর মতে, কৃষি খাতে নারীর অবদানকে পারিবারিক শ্রম হিসেবে গণ্য করা হয়। যা সম্পূর্ণ অবৈতনিক। অথচ নারীদের খামার ও পরিবারের উৎপাদনের জন্য দ্বিমুখী চাপ সহ্য করতে হয়।

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ফেলো ড. এম আসাদুজ্জামান বলেন, “দেশে কৃষি উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত বিভিন্ন কাজের সঙ্গে নারী শ্রমশক্তির ৬৮ শতাংশই জড়িত। তারপরেও পুরুষ কৃষিশ্রমিকের তুলনায় নারীরা ৪১ শতাংশ কম মজুরি পায়। ভূমিতেও নারীর সমধিকার নেই। বাজারে প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রেও নারীদের নানা প্রতিবন্ধকতা পার করতে হয়।”

এক দশকে ৫০ লাখ নারী শ্রমশক্তিতে যুক্ত

নারী প্রগতি সংঘের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে গত এক দশকে বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বাড়তি শ্রমশক্তি যুক্ত হয়েছে। এদের প্রায় ৫০ লাখই নারী শ্রমিক।

২০০৫-০৬ সালের শ্রমশক্তি জরিপের হিসাব অনুযায়ী, দেশের ১ কোটি ২০ লাখ নারী শ্রমিকের প্রায় ৭৭ শতাংশই গ্রামীণ নারী। তাঁরা মূলত কৃষিকাজ, হাঁস-মুরগি পালন, পশুপালন, মাছ চাষ ইত্যাদি কৃষিসংক্রান্ত কাজে যুক্ত।

সংবাদ সম্মেলনে নারী কৃষকদের স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি তাঁদের রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা ব্যবস্থার আওতায় আনা, সর্বজনীন উত্তরাধিকার আইন প্রণয়ন করা, প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করার দাবি জানানো হয়।

এ ছাড়া নারীর কাছে কৃষি সম্প্রসারণ সেবা পৌঁছে দেওয়া, বাজারে নারীর প্রবেশগম্যতা বাড়াতে বাজারের নারী কৃষকদের জন্য সংরক্ষিত স্থান রাখার প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরা হয়।

এ বিষয়ে নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবির বেনারকে বলেন, “জিডিপিতে কৃষির অবদান কমে আসছে বলে অনেকেই বলে থাকেন। তবে এর অর্থ এই নয় যে, তাতে নারীর অবদান কমছে। বরং পরিসংখ্যান বলছে, কৃষিতে নারীর অবদান আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে।

তিনি বলেন, “দেশে বিদ্যমান সমাজকাঠামো ও প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কৃষিতে নারীর অবদানকে অবহেলা করার সাধারণ প্রবণতা রয়েছে। এ কারণেই কৃষিতে নারীর অবদান স্বীকৃতি পাচ্ছে না। তবে একটি টেকসই জীবিকায়ন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে নারীর এ অবদানকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, নারীর ক্ষমতায়ন ছাড়া দেশ থেকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য ঘোচানো যাবে না। তাই রাষ্ট্র ও সমাজকে এ বিষয়ে এখনই নজর দিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ও নারী নেত্রী আয়েশা খানম বেনারকে বলেন, “কৃষি ক্ষেত্রে মোট ২২টি কাজের মধ্যে নারী ১৯-২০ কাজই করে থাকেন। তবুও গ্রামীণ অর্থনীতিতে তাঁদের অবদান কিংবা কৃষক হিসেবে তাঁদের স্বীকৃতি নেই।”

তিনি বলেন, “আমাদের নারীদের অর্জন অনেক আছে। তবে আরও অনেক জায়গায় আমরা পিছিয়ে রয়েছি। আমাদের নীতিনির্ধারকেরা শুধু উন্নতির কথাটাই বলেন। রাষ্ট্র, সমাজকে এখন সেই পিছিয়ে পড়া জায়গাগুলোর প্রতিও দৃষ্টি দিতে হবে।”

তবে বাংলাদেশের নারীরা অনেক দূর এগিয়ে গেছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। আর কৃষিতে নারীদের স্বীকৃতি না পাওয়ার কারণ হিসেবে পশ্চাৎপদতা ও মূল্যবোধের অভাবকেই দায়ী করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সংসদ সদস্য ও নারী নেত্রী শিরিন আখতার বেনারকে বলেন, “কৃষক নামে নারীকে মূল্যায়িত না করার অন্যতম কারণ সামাজিক পশ্চাৎপদতা ও সামাজিক মূল্যবোধের অভাব। এই জায়গাটাতেই আমাদের সংকট রয়েছে। এ ছাড়া প্রশাসনিকভাবে সংজ্ঞায়িত না করাটাও বড় সমস্যা।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।