এবার গ্রামীণ ব্যাংকের সংস্কার আটকে দেওয়ার অভিযোগ ইউনূসের বিরুদ্ধে

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.07.07
BD-Yunus দেশের গ্রামীণ অঞ্চলে স্থাপিত গ্রামীণ ব্যাংকের একটি শাখা, যেখান থেকে দরিদ্র নারীদের ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে স্বাবলম্বি করার চেষ্টা করা হয়। জুলাই,২০১৫
বেনার নিউজ

গ্রামীণ ব্যাংক আইন সংশোধন হলেও এর চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দিতে পারেনি সরকার। আর এ জন্য ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দুষে আসছে সরকার। ৬ জুলাই গ্রামীণ ব্যাংক সংস্কারে ব্যর্থতার জন্য তাঁকেই সরাসরি দায়ী করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

ড. ইউনূসকে সরিয়ে দেওয়ার পর অনতিক্রম্য বৃত্তে আটকে গেছে গ্রামীণ ব্যাংক। গত প্রায় সাড়ে তিন বছরে গ্রামীণ ব্যাংকে এমডি বা চেয়ারম্যান নিয়োগ দিতে পারেনি সরকার।

এর আগে গত ৬ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্তব্য করেন, “পদ্মাসেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করার জন্য সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে দিয়ে বিশ্বব্যাংককে ফোন করিয়েছিলেন ড. ইউনূস। পদ্মাসেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক প্রথম যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা ওই সংস্থার নিজস্ব সিদ্ধান্ত ছিল না”, বলেও মত দেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী এ বক্তব্য দেওয়ার পর ৭ মে ড. ইউনূসের সমালোচনা করে পরিকল্পনা মন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল বলেন, “পদ্মাসেতু প্রকল্পে ঋণ বাতিলের জন্য কেউ না কেউ কলকাঠি নেড়েছেন। কারও না কারও হাত ছিল। সেই জন্য এটি (পদ্মাসেতু) হয়নি। তাই আমি বলব, ইউনূসের উচিত হবে, তার অবস্থান স্পষ্ট করা।”


ইউনূসের বিরুদ্ধে অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা

পদ্মাসেতু নিয়ে সেই সমালোচনা কিছুটা থিতিয়ে এলেও এবার গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকার দুশ্চিন্তায় পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ গঠনে অপারগতা প্রকাশ করেছে।

“বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়ে দিয়েছে, তাদের কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট হয়, তারা গ্রামীণ ব্যাংকের নির্বাচন করতে পারবে না,” ৬ জুলাই সাংবাদিকদের জানান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

“অবশ্য তারা রেগুলেটরি বডি। রেগুলেটরি বডি হিসাবে তাদের তা করা ঠিকও নয়,” মনে করেন অর্থমন্ত্রী।

এই পরিপ্রেক্ষিতে এখন বিধিমালা সংশোধন করার কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, বিধিমালার যে অংশে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচনের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে, সেখানে ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের বদলে অন্য কিছু’ লিখতে হবে।

গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালক নির্বাচনে গত ৬ এপ্রিল বিধিমালা জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বিধিমালায় পরিচালক নির্বাচনের জন্য ছয় মাস সময় বেঁধে দেওয়া হয়, যা আগামী ৫ অক্টোবর শেষ হচ্ছে।

গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার কথা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, এক সময় ক্ষুদ্র ঋণ বিষয়টি ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় যখন, তখন অধ্যাপক ইউনূসের নাম উঠে আসে।

“দুর্ভাগ্য এই যে এক সময় উনি নিজেই ইনস্টিটিউট হিসেবে দাঁড়িয়ে যান। এটা নিয়ে আমাদের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হয়,” জানান অর্থমন্ত্রী।

অবশ্য ড. ইউনূসের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, গ্রামীণ ব্যাংকের ৫৪টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ঋণের ফাঁদে আটকে আছে।

অবসরের মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার পরও পদে থাকার কারণ দেখিয়ে ২০১১ সালের ২ মার্চ গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব থেকে ইউনূসকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর বিরুদ্ধে ইউনূস উচ্চ আদালতে গেলেও রায় তার বিপক্ষে যায়।



গ্রামীন ব্যাংকের পরিচালনা নিয়ে সংকট

গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনায়  একটি কমিশন গঠন করে সরকার। তারপর থেকে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে ইউনূস ও সরকারের কর্তা-ব্যক্তিদের বাদানুবাদ চলছে।

অর্থমন্ত্রী আরো বলেন,“গ্রামীণ ব্যাংকের অনেক উন্নয়ন করা দরকার। আমরা এটার (গ্রামীণ ব্যাংকের) উন্নতি করতে চাই। কিন্তু তার (ইউনূসের) সমর্থকেরা মামলা করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।”

ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের চেষ্টাকে ‘শান্তি স্থাপন’ বিবেচনা করে ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় গ্রামীণ ব্যাংক এবং এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ ইউনূসকে। প্রায় ৮৪ রাখ গ্রামীণ নারী এবং ২৫ হাজার কর্মী এই ব্যাংকটি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, যার গতি অনেকটা শ্লথ হয়ে পড়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। উচ্চ আদালতে গেছে গ্রামীণ ব্যাংকের নয়জন পরিচালকের পদ শূন্য ঘোষণার বিষয়টি। গত ২৯ এপ্রিল একটি রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের নির্বাচিত নয়জন পরিচালকের পদ শূন্য ঘোষণা করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চান হাইকোর্ট।

গত ৩০ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয় গ্রামীণ ব্যাংকের নয়জন নির্বাচিত পরিচালকের পদ শূন্য ঘোষণা করে চিঠি দেয়। চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি তাঁদের মেয়াদ শেষ হয়। ওই চিঠির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ব্যাংকের পরিচালক তাহসিনা খাতুন।


ইউনূসের কর পরিশোধ নিয়ে বিরোধ

ড. ইউনূসের দানের অর্থ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর। এ বিষয়ে তিনি ছয় মাসের জন্য  উচ্চ আদালতের সুরক্ষা পান গত ২ এপ্রিল থেকে।

ইউনূস সেন্টারের বক্তব্য অনুযায়ী, ২০১১-১২ থেকে তিনটি করবর্ষে তিনি ৭৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা দান করেছেন। কর পরিশোধের পর ৭৭ কোটি টাকা তিনি মুহাম্মদ ইউনূস ট্রাস্ট-এর মাধ্যমে অনুদান, গবেষণা ও সামাজিক উন্নয়নের খাতে দান করেছেন। তার মধ্যে ৫ কোটি টাকা পারিবারিক কল্যাণের জন্য ইউনূস ফেমিলি ট্রাস্টকে দিয়েছেন।সব দান ও অনুদান তিনি ট্যাক্স রিটার্নে দেখিয়েছেন।কর কর্তৃপক্ষ ২০১৩ সাল পর্যন্ত কোনো প্রশ্ন তোলে নাই, এবং তাকে ট্যাক্স পেমেন্ট সার্টিফিকেটও দেয়া হয়।কিন্তু এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, দান কর বাবদ ১৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা জমা করেননি ইউনূস।

“তিনি (ড.  ইউনূস) বিপুল অর্থ প্রবাসী আয় হিসেবে দেশে এনেছেন, যা করমুক্ত। আর যে টাকা তিনি দান করেছেন, তাতে কর অব্যাহতি দেওয়া রয়েছে,” বেনারকে জানান ড. ইউনূসের কর পরামর্শক মাহবুবুর রহমান ।

“গত কয়েক মাস ধরে ড. ইউনূস সম্পর্কে সরকারের বক্তব্য থেকে মনে হয় তিনি একজন মহাক্ষমতাধর ব্যক্তি। এ রকম একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিকে দেশে মর্যাদা বা সম্মান না দিতে পারার ব্যর্থতা আমাদের,” বেনারকে জানান ড. বদিউল আলম মজুমদার, যিনি সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজনের সম্পাদক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।