খুশির ঈদে মহাসড়কে মৃত্যুর উৎসব
2015.07.27
ঈদের আগে ও পরে সড়ক পথে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। ১০ দিনে প্রায় আড়াইশ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। মৃত্যুর এই হার অস্বাভাবিক স্তরে পৌঁছলেও দূর্ঘটনা কমিয়ে আনতে সরকারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।
দৈনিক প্রথম আলো ২৫ জুলাই হিসাব দিয়েছে, ঈদুল ফিতরের আগে ও পরে মিলিয়ে গত ১০ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪২ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছে আরও অন্তত ২০০ জন। ঈদযাত্রায় মহাসড়কে প্রাণহানির এই সংখ্যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
খুশির ঈদ শেষে এখন মানুষ ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় কর্মস্থলে ফিরছেন। কিন্তু অনেকেই আবার ঘরে ফিরছেন লাশ হয়ে, আহত হয়ে কারও ঠাঁই হচ্ছে হাসপাতালে।
“দুর্ঘটনা ও হতাহতের যে সংখ্যা আমরা পেয়েছি, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়েও বেশি,” বেনারকে জানান যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
ওই সমিতির হিসাবে ২০১৪ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে প্রায় সাড়ে আট হাজার মানুষ। দুর্ঘটনা ঘটে প্রায় ছয় হাজার। অবশ্য সরকারি হিসাবে দুর্ঘটনা ও নিহতের সংখ্যা দুই হাজারের সামান্য বেশি।
এবার সড়কপথে মূল ঈদযাত্রা শুরু হয় ১৫ জুলাই থেকে। হতাহতের এই হিসাব ১৫ জুলাই থেকে ২৪ জুলাই সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের। এই ১০ দিনে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় পৌনে দু’শ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম সংযোগ সড়কেই ১০ কিলোমিটারের মধ্যে চারটি দুর্ঘটনায় ৩১ জনের প্রাণহানি হয়েছে।
দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ
বড় দুর্ঘটনাগুলোর ধরন বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মূলত বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, ফিটনেসবিহীন যানের আধিক্য এবং মহাসড়কে ধীর গতির যানবাহনের অনুপ্রবেশ এসব দুর্ঘটনার কারণ। আর এসব নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারার কারণ হলো পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অতি মুনাফার লোভ এবং পরিবহন ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতি।
“দেশের যে যোগাযোগ অবকাঠামো আছে, তা ঈদের মতো বড় উৎসবের বিপুল মানুষের চাপ নেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। আবার অধিক মুনাফার লোভে পরিবহন চালক-মালিকেরা তখন অতিরিক্ত ট্রিপ দেয়। ফলে চালক এবং পরিবহন—কারও বিশ্রাম মেলে না,” জানান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক।
সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক ওই পরিচালক বলেন, ফিটনেসবিহীন যানবাহন তো আছেই, ভালো যানবাহনও বিরামহীন চলাচলের কারণে অচল হয়। আর চালকদের মধ্যে বেপরোয়া গতি তোলার প্রবণতা তো আছেই।
“ঈদে যেসব যানবাহন সড়ক থেকে খাদে ছিটকে পড়তে দেখা গেছে, ধারণা করা যায় পিচ্ছিল সড়কে অধিক গতির কারণেই তা হয়েছে,” জানান সামছুল হক।
তিনি বলেন, সড়কের ওপরে বিটুমিনের যে কালো আস্তর দেওয়া হয়, তা বৃষ্টিতে পিচ্ছিল হয়ে পড়ে। অধিক গতির কারণে যানবাহনের চাকা তা কামড়ে ধরে রাখতে পারে না। ফলে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।
পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদে যাত্রী বেড়ে যাওয়ায় প্রতিটি পরিবহন কোম্পানি বাসের যাত্রা (ট্রিপ) ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়। এ সময়ে চালকদের একটানা গাড়ি চালাতে হয়।
“মুনাফার লোভে বিরামহীন বাস চালানোর বিষয়টি পুরো সত্য নয়। আর এর জন্যই সড়ক দুর্ঘটনা বেশি হয়, এমন ধারনা ঠিক নয়,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সোহাগ পরিবহনের স্বত্বাধিকারী ফারুক তালুকদার।
তাঁর মতে, চালকদের মধ্যে গতি চড়ানোর একটা নেশা আছে। আর সড়কে প্রচুর ধীর গতির যানবাহন চলার কারণে গতিনিয়ন্ত্রণে সমস্যা হয় এবং দুর্ঘটনা ঘটে।
সিদ্ধান্ত হয়, কিন্তু কার্যকর হয় না
অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়কে অটোরিকশা, নছিমন, করিমন, ভটভটি ও ইজিবাইকের মতো ধীর গতির যান চলাচল বন্ধ করার সিদ্ধান্তের কথা বলা হচ্ছে প্রায় এক দশক ধরে। কিন্তু এসব সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা নেই।
সিদ্ধান্ত কার্যকর না হওয়ায় এখন সড়ক-মহাসড়ক অধিকতর প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে বলে তিনি মনে করছেন।
২০০৬ সালে সড়ক নিরাপত্তা উপদেষ্টা কাউন্সিলের বৈঠকে এসব ধীর গতির যানবাহন সড়ক থেকে উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর ২০১২ সালে কাউন্সিলের আরেক বৈঠকে একই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। তখন থেকে প্রতিটি বৈঠকেই এই সিদ্ধান্ত আলোচিত হয়েছে এবং তা বাস্তবায়ন করার ঘোষণা এসেছে।
সর্বশেষ গত ২২ জুলাই এক সভায় মহাসড়কে অটোরিকশাসহ ছোট যান চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা জানান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
যেখানেই বড় দুর্ঘটনা ঘটে, সেখানেই সড়ক চার লেন করার ঘোষণা দিয়েছেন ওবায়দুল কাদের। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, জন-চাপে এভাবে নেওয়া তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের বেশির ভাগই পরে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।
তবে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের আদলে সারা দেশে প্রায় দেড় শ দুর্ঘটনা প্রবণ স্থানে (ব্ল্যাক স্পট) সড়ক বিভাজক বসানো এবং বাঁক সোজা করার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে এইসব প্রকল্প বাস্তবায়নে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়া প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বেনারকে বলেন, “অনেকগুলো মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সবার সমন্বয়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে।”
মহাসড়কে ধীরগতির যানবাহন বন্ধে ১ আগস্ট থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে বলেও জানান মন্ত্রী।
সরকার মোটরযান আইন হালনাগাদ করার উদ্যোগ নেয় ২০১০ সালে। ২০১২ সালে একটি খসড়াও প্রস্তুত করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা আইনে পরিণত করতে পারেনি সরকার।
“মোটরযান আইনটি যুগোপযোগী করা খুবই জরুরি। দুর্ঘটনায় দায়ীদের শাস্তির ধারায় এই অপরাধকে জামিন-অযোগ্য করার জন্য আমরা সরকারকে পরামর্শ দিয়েছি, এরপর আর বিষয়টি এগোচ্ছে না” বেনারকে জানান সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন।
ভুক্তভোগিদের প্রতিক্রিয়া
গত ২৩ জুলাই টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলায় পাটখাগুড়ি এলাকায় ঢাকাগামী বিনিময় পরিবহনের একটি বাস খাদে পড়ে গেলে আটজন নিহত হয়। ওই বাসের আরোহী রাণী বেগম ((৪২) বেনারকে জানান, “বৃষ্টির মধ্যে বাসটি এতো জোরে চলছিল যে, এক পর্যায়ে সেটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মহাসড়ক থেকে ছিটকে খাদে পড়ে যায়।”
ক্ষুব্ধ ওই যাত্রী বলেন, বাসের অনেকেই চালককে আস্তে গাড়ি চালাতে বলেছিল। কিন্তু চালক কারও কথা শোনেনি।
“আমাদের সঙ্গে যারা নিহত হয়েছে তাদের পরিবার হয়তো কিছু অর্থ সহায়তা পাবে। কিন্তু ওই পরিবারের সদস্যরা সারাজীবন ভুগবে। এর দায় পুরোটাই সরকারের ওপর বর্তায়,” বেনারকে জানান ফারজানা খাতুন (৩৮), যিনি ওই বাসে থাকলেও সামান্য আহত হন।
এ ঘটনার পর দাফন ও ক্ষতিপূরণ হিসেবে জেলা প্রশাসন আটটি পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দিয়েছে।
“দুর্ঘটনার পর পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশ হয়, থানায় একটি মামলা হয়। এরপর সবাই ভুলে যায়। আবারও দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে,” জানান ফারজানা।