ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনার ৫৯ ভাগ আসামি শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ
2015.10.22

ঢাকা মহানগর আদালত থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, রাজধানীতে গত ছয় বছরে গাড়িচাপায় নিহতের ঘটনায় ৯৩৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৭৩টি মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে। তদন্ত শেষ হওয়া মামলার মধ্যে ৩৯৯টি বা ৫৯ শতাংশ মামলায় পুলিশ কোনো আসামি শনাক্ত করতে পারেনি।
তদন্তের এই হাল নিয়ে অসন্তুষ্ট ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমসহ নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরতরা। পুলিশ ৪১ শতাংশ আসামি শনাক্ত করতে পারলেও চূড়ান্ত বিচারে এদের কতজনের সাজা হয়, সেই হিসাব পাওয়া যায়নি।
“যেসব মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর তালিকা পেলে আমরা পর্যালোচনা করে দেখতে পারি। যদি সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়ার পরও অসৎ উদ্দেশ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে বলে প্রমাণ মেলে, তাহলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” বেনারকে জানান পুলিশের কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া।
“আদালত যদি বিচারিক মনোভাব নিয়ে এসব মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ না করে আবার পুনরায় তদন্তে পাঠান, তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে। সে ব্যাপারে বিচারকদেরও আন্তরিক হওয়া উচিত,” বেনারকে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
দুটি দৃষ্টান্ত
রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের কাওলা পদচারী-সেতুর পাশের বাসস্ট্যান্ডে গত ১৪ জুন রাতে ৬০ বছর বয়সী আবদুস সাত্তার গাড়িচাপায় নিহত হন। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় মামলা হয়। সাড়ে তিন মাস তদন্তের পর এই মামলা প্রমাণের জন্য পুলিশ কিছুই পায়নি।
“অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু গাড়ির চালককে চিহ্নিত করতে পারিনি। এ জন্য আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি,” বেনারকে জানান পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা ও উপপরিদর্শক এস এম মামুনুর রহমান।
শুধু এই দুর্ঘটনা নয়, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব সড়ক দুর্ঘটনার মামলা হয়, তার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চালক ও যানবাহনকে চিহ্নিত করতে পারে না পুলিশ।
এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, বিশিষ্ট সাংবাদিক জগলুল আহমেদ চৌধুরী দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর কাউকে চিহ্নিত করতে না পেরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া।
গত বছরের ২৯ নভেম্বর ঢাকার কারওয়ানবাজার এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান জগলুল আহমেদ। ছয় মাসের মাথায় গত ৩১ মে পুলিশ আদালতে যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়, তাতে বলা হয় দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত বাস বা এর চালককে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
“গাড়ি দুর্ঘটনার মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন কিংবা অভিযোগপত্রে দেওয়ার আগে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলির মতামত নেওয়ার বিধান আছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে তাঁর কোনো মতামত চাওয়া হয়নি। কেন চাওয়া হয়নি, তা তিনি বলতে পারবেন না,” বেনারকে জানান ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান সরকারি কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু।
পুলিশের একজন উপকমিশনার বলেন, গুরুত্বপূর্ণ মামলার ক্ষেত্রেই পুলিশ কৌঁসুলিদের মতামত নেয়। দুর্ঘটনার মতো সাধারণ মামলায় মতামত নেওয়া হয় না। দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর মতো ঘটনাকে পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না বলে স্বীকার করেন তিনি।
ঢাকার দুই থানার চিত্র
গত ছয় বছরে ঢাকা মহানগরের যাত্রাবাড়ী ও বিমানবন্দর থানায় সর্বাধিক দুর্ঘটনার মামলা রেকর্ড হয়েছে। যাত্রাবাড়ীতে হয়েছে ৯৭টি ও ঢাকা বিমানবন্দরে ৮৫টি। এর মধ্যে বিমানবন্দর থানা-পুলিশ তদন্ত শেষে ৫৪টি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন ও ২৭টি মামলায় অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে।
“এটা ভাবতেও কষ্ট হয় যে বেশির ভাগ মামলার আসামি চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে তদন্ত সংস্থা। ঘটনার শিকার পরিবারের লোকজন যদি বিচার পেত, তাহলে কিন্তু এত দুর্ঘটনা ঘটত না,” বেনারকে জানান ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন।
চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন তাঁর স্ত্রীকে হারান সড়ক দুর্ঘটনায়। এরপর থেকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চনের মৃত্যুবার্ষিকীতে তিনি জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা দিবস ঘোষণা করেন, যা সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ না করলেও গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সংগঠন দিবসটি পালন করে।
পথচারীদের মত হচ্ছে, বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। পর্যাপ্ত ফুট ওভারব্রিজ না থাকার কারণে প্রায় প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হতে হচ্ছে হাজারো পথচারীকে। ফলে গাড়ির নিচে চাপা পড়ে যারা যাচ্ছে অনেকে। সড়কে বাতি না থাকায় রাতে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে।