বিচ্ছিন্নতাবাদী ‘আরাকান আর্মি’র শীর্ষ নেতা বাংলাদেশে গ্রেফতার
2015.10.14
একজন সহযোগী গ্রেফতারের দুই মাসের মাথায় মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘আরাকান আর্মি’র কথিত শীর্ষ নেতা রেনিন সু'কে আটক করার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশের পুলিশ ও বর্ডার গার্ড-বিজিবির সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী। গত আগস্টে একদল টহলরত বিজিবি সদস্যের উপর হামলা ও গোলাগুলির পর যার খোঁজ পায় পুলিশ। আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে পাঁচ দিনের পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার আদেশ দিয়েছে আদালত।
এই ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা’ গ্রেফতারের ঘটনা প্রতিবেশি হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি মিয়ানমারের আস্থা বাড়াবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলার ইসলামপুর আদর্শ নতুনপাড়া এলাকার একটি নির্মাণাধীন মসজিদ থেকে রেনিন সু’কে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানান রাজস্থলী থানার ওসি ওহিদ উল্লাহ সরকার।
এসময় তার কাছ থেকে ৪১ হাজার ১২০ টাকা, বিভিন্ন ব্যাংকের ছয়টি ক্রেডিট কার্ড, নেদারল্যান্ডসের একটি পাসপোর্ট, একটি ল্যাপটপ ও একটি পরিচয়পত্র উদ্ধার করা হয় বলে জানান তিনি।
জানা যায়, রাঙামাটি বিজিবির মেজর শাব্বির আহমেদ, মেজর কামাল পাশা এবং ওসি ওহিদ উল্লাহ এই যৌথ অভিযানের নেতৃত্ব দেন।
পাঁচ দিনের পুলিশ হেফাজত
আটকের পর বুধবার রেনিন সু’কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার আবেদন করে পুলিশ। রাঙামাটির অতিরিক্ত বিচারিক হাকিম সাবরিনা আলী তার পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
পুলিশের পরিদর্শক মোমিনুল ইসলাম বলেন, “বিকালে রেনিন সু’কে আদালতে হাজির করে রাজস্থলী থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে দায়ের করা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের হেফাজতের (রিমান্ড) আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।”
বুধবার মুদ্রা আইনে রেনিন সু’র বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষ থেকে রাজস্থলী থানায় একটি মামলা করা হয় বলে জানান রাজস্থলী থানার ওসি ওহিদ উল্লাহ সরকার।
বাংলাদেশে বসেই চালাচ্ছিলেন আরকান আর্মির কার্যক্রম
স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি, রেনিন সু মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘আরাকান আর্মি’র একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা। যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা রয়েছে। পুলিশ বলছে, রাঙ্গামাটিতে অবস্থান করেই আরাকান আর্মির কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন রেনিন সু।
জানা যায়, চিকিৎসা শাস্ত্রের ডিগ্রিধারী রেনিন এক সময় নেদারল্যান্ডসে বসবাস করতেন।তার কাছে নেদারল্যান্ডের পাসপোর্টও পাওয়া যায়। তবে গত কয়েক বছর ধরে তিনি রাজস্থলীতে বাড়ি বানিয়ে স্থানীয় এক মার্মা তরুণীকে বিয়ে করে রাঙামাটিতেই থাকছিলেন। আর সেখান থেকেই আরাকান আর্মির কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন বলে ধারণা করছে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
স্থানীয় সাংবাদিকদের কেউ কেউ বলছেন ১৯৯৬ সালে প্রথম বাংলাদেশে বসতি গড়েছেন বলে তারা জানতে পেরেছেন।
যেভাবে রেনিনের খোঁজ পায় পুলিশ
গত ২৬ আগস্ট বান্দরবানের থানচির সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিজিবির একটি যৌথ টহল দলের ওপর হামলা চালায় আরাকান আর্মির সদস্যরা। সে হামলা ও গোলাগুলির পর রাজস্থলীতে রেনিন সু’য়ের খোঁজ পায় পুলিশ। তার দুই দিন পর রেনিনের দুই তলা ওই বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ ও বিজিবি।
সে অভিযানে রেনিনকে আটক পাওয়া না গেলেও তার সহযোগী অং ওয়েন রাখাইনকে ওই বাড়ি থেকে আটক করা হয়। যেখানে আরাকান আর্মির তিনটি পোশাক, ওই পোশাক তৈরির ৩০ গজ কাপড়, তিনটি ল্যাপটপ, তিনটি ক্যামেরা ও দুটি ঘোড়া পাওয়া যায়। মংচু অং মারমা ও চুইস অং মারমাও নামে ওই বাড়ির দুই কেয়ারটেকারও গ্রেফতার হয়। তারা এখন কারাগারে আছেন।
নিজেকে আরাকান আর্মির একজন সদস্য বলে গতমাসে রাঙামাটির আদালতে স্বীকারোক্তি দেন আটক ওয়েন রাখাইন। একইসঙ্গে রেনিন সু’র বিষয়েও তথ্য দেন তিনি। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতেই শেষ পর্যন্ত রেনিন সুকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্টা আঘাতের হুমকি
আগস্টে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যৌথবাহিনীর অভিযান চলাকালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হুমকিও দেন রেনিন সু। ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন “এখনই যাতে সব ধরনের সামরিক অভিযান বন্ধ করা হয়। অন্যথায় এটি সব যোদ্ধার কবরে পরিণত হবে। কারণ আমরা আরাকান আর্মি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করতে চাইনা। কিন্তু তারা যদি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে আমাদের ওপর আক্রমণ করে, তবে আমাদেরও পাল্টা আঘাত হানা উচিত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী চাইলে আলোচনার দরজাও খোলা আছে। যদি আপনি এই পোষ্ট পেয়ে থাকেন, দয়া করে সব গনমাধ্যমের কাছে এটি পাঠান।”
গত সপ্তাহে বান্দরবন থেকে দুই পর্যটক তাদের দুইজন গাইড সহ অপহরনের ঘটনায় ধারনা করা হচ্ছে আরাকান আর্মির লোকজন তাদেরকে সীমান্তের ওপারে ধরে নিয়ে গেছে।
‘প্রতিবেশির অবিশ্বাসের জায়গা দূর করবে’
বাংলাদেশের মাত্র দুই প্রতিবেশির একটি হওয়া স্বত্বেও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মসৃন নয়, যতটা অন্য প্রতিবেশি ভারতের সঙ্গে দেখা যায়। কূটনীতিকরা মনে করেন, বাংলাদেশের প্রতি এখনও আস্থা আনতে পারেনি দীর্ঘ দিনের সেনা শাসনের দেশটি। এর মধ্যে রোহিঙ্গা ইস্যুও অন্যতম।
তবে বাংলাদেশের চেষ্টায় ধীরে ধীরে সম্পর্কের বরফ গলাতে শুরু করেছে মিয়ানমার। এরই মধ্যে দেশটির বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আটক দুদেশের মধ্যকার সম্পর্কে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করনে বিশ্লেষকরা।
এ প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বেনারকে বলেন, “আরাকান আর্মি’র নেতা আটক করার ঘটনা একটু হলেও প্রতিবেশি বাংলাদেশের প্রতি মিয়ানমারের দীর্ঘদিনের অবিশ্বাস দূর করবে। তারা জানতে পারবে, বাংলাদেশ তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী কোন গোষ্ঠীকে আশ্রয় দেয়নি। আমরাও সেসব সন্ত্রাসী সংগঠনের বিরুদ্ধে। যা দুদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”