আরও নাশকতার আশঙ্কা, চলছে শত শত গ্রেপ্তার

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.11.10
BD-arrest সোমবার রাতে ঢাকায় ১১ জন জেএমবির সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১০ নভেম্বর,২০১৫
বেনার নিউজ

গত কয়েক দিন ধরে বিএনপি–জামায়াতসহ বিরোধী নেতা–কর্মীদের গ্রেপ্তার ও ধরপাকড় বেড়েছে। তবে পুলিশ বলছে, এটা রুটিন গ্রেপ্তার। বিএনপির পক্ষ থেকে গত রোববার দাবি করা হচ্ছে, গত কয়েক দিনে বিরোধী দলের প্রায় ৫ হাজার নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এবার ঢাকা সেনানিবাসের প্রবেশ পথে তল্লাশির সময় দুর্বৃত্তের হাতে মিলিটারি পুলিশের (এমপি) এক সদস্যকে জখম করার পর ফিল্মি স্টাইলে ওই ঘাতক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।  

ঢাকার গাবতলি ও ঢাকার অদূরে আশুলিয়ার দুই পুলিশ সদস্যকে কুপিয়ে হত্যার পর গতকাল মঙ্গলবার সেনানিবাসের কচুক্ষেত এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

এ ঘটনার পাশাপাশি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি’র সদস্য সন্দেহে ঢাকার উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নতুন করে বিরোধী দল বিএনপি–জামায়াতের নেতা–কর্মীদের গ্রেপ্তার শুরু করেছে পুলিশ।

এই পরিস্থিতিতে দেশের ৩৮জন বিশিষ্ট নাগরিক মঙ্গলবার বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, জনগণের নিরাপত্তার অধিকার খর্ব হওয়ায় জনমনে যে হতাশা ও আতঙ্কের সৃষ্টি হচ্ছে তা দূর করার দায়িত্ব সরকারেরই।

“সারা বিশ্ব যখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সরকারকে ব্যর্থ বলছে, তখন সরকার বলছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো। এর চেয়ে লজ্জার আর কিছু নেই,” বেনারকে জানান বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ।


চলছে র‍্যাব পুলিশের ধরপাকড়

গত কয়েকদিনের রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের পর সারাদেশে র‍্যাব–পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করেছে।  দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দর, বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন, লঞ্চঘাটসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঘিরে কড়া নিরাপত্তার আয়োজন করা হয়েছে।

পুলিশ জানায়, দেশের ৩২ জেলায় চলছে বিশেষ অভিযান। নাশকতাকারী ও বিভিন্ন মামলার আসামিদের গ্রেফতারে চলতি মাসের শুরু থেকে এই অভিযান শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এতে জামায়াতের প্রভাবে থাকা এলাকার ওপর বিশেষ নজরদারি রাখা হচ্ছে।

পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত সোমবার রাত থেকে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৬ জেলায় ৪৭০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে বিএনপির ১২৩জন, জামায়াতের ১৬৫জন। এ ছাড়া ১৮২ জনকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

তবে, গত ৬ ও ৭ নভেম্বর দেশের আট জেলায় যৌথ অভিযানে বিএনপি–জামায়াতের ১৫৩ জনসহ ৭২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। (প্রথম আলো, ৮ নভেম্বর)। জেলগুলো হচ্ছে; চট্টগ্রাম, বগুড়া, সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ফরিদপুর, নোয়াখালি, সিরাজগঞ্জ ও লক্ষীপুর। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেলায় ওই ২৪ ঘন্টায় ৪৮১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এদিকে গত শনিবার রাত থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৬২৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৩৪ জন বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী। (সমকাল, ৯ নভেম্বর ২০১৫)

“সব তথ্য দলের কাছে নেই। কাকে, কোথা থেকে তুলে নেওয়া হচ্ছে তা আন্দাজ করা যাচ্ছে না। তবে এ মাসের শুরু থেকে এ পর্যন্ত নতুন করে বিরোধীদলের প্রায় পাঁচ হাজার নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে,” বেনারকে জানান বিএনপির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন।

“সরকার যদি মনে করে বিরোধী দলের নেতা–কর্মীদের কারাগারে রাখবে, তাহলে ঢালাও আদেশ দিলেই পারে। তখন দেশের সব বিরোধী নেতা-কর্মী কারাগারে গিয়ে হাজির হবেন,” বেনারকে জানান সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন।

তিনি বলেন, আদালতকে ব্যবহার করে সরকার ও পুলিশ বিরোধী দলের নেতা–কর্মীদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। আদালতে জামিন হওয়ার পরও নতুন মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। যেভাবে অবিচার ও জুলুম ও নির্যাতন চালানো হচ্ছে, তা চলতে পারে না।

এদিকে সারাদেশে বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের ধরপাকড় করা হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গত সোমবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, বিএনপি-জামায়াত নয়, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নাশকতাকারীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে যারা দেশে বোমাবাজি করে ও অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে চায় তাদের আমরা ধরে থাকি। সেই কাজের অংশ হিসাবে বেশ কিছু দুর্বৃত্তকে আটক করা হয়েছে।”


দুর্বৃত্তকে ফিল্মি স্টাইলে গ্রেপ্তার

আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মঙ্গলবার বলা হয়, “কাফরুল এলাকায় কর্তব্যরত একজন মিলিটারি পুলিশকে একজন পথচারী পেছন থেকে ধারালো অস্ত্রের মাধ্যমে আঘাত করেন। এতে উক্ত মিলিটারি পুলিশ সদস্য সামান্য আহত হন। কর্তব্যরত অন্য সামরিক সদস্যগণ সন্দেহভাজন একজন হামলাকারীকে আটক করেছে। বিস্তারিত জানার জন্য ইতিমধ্যেই তদন্ত শুরু হয়েছে।”

প্রত্যক্ষদর্শী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সূত্রে জানা গেছে, সেনানিবাসে প্রবেশের পথে নির্ধারিত লেন ছাড়া রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ থাকলেও গতকাল সকালে একটি রিকশা হঠাৎ করে গাড়ির জন্য নির্ধারিত লেনে ঢুকে পড়ে। রিকশাটি সোজা যাওয়ার চেষ্টা করলে তল্লাশি চৌকিকে দায়িত্বরত মিলিটারি পুলিশের সদস্য সামিদুল রিকশাটিকে থামিয়ে রিকশাচালকের সঙ্গে কথা বলেন।

এ সময় এক যুবক রাস্তার উল্টো দিক থেকে এসে হঠাৎ করে আক্রমণ করে বসে।  ধারালো অস্ত্র দিয়ে যুবকটি তাঁর বাম ঘাড়ে ও চোয়ালে আঘাত করেন। তিনি বাধা দিতে গেলে সামিদুলের হাতেও আঘাত করা হয়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এগিয়ে এলে ওই যুবক দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। যুবকের পেছনে ধাওয়া করে উত্তর কাফরুলের একটি বাসার পাঁচতলা থেকে তাঁকে ধরে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিচালকের কার্যালয়ে আনা হয়।

ঘটনার পর  হামলার স্থানটি মিলিটারি পুলিশ সদস্যরা ঘিরে ফেলেন। সাধারণ যানবাহন চলাচলে বন্ধ করে দেওয়া হয়। মাইকের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে আশপাশের সড়কে জড়ো না হতে ঘোষণা দেন মিলিটারি পুলিশ সদস্যরা।


৩৮ বুদ্ধিজীবীর যৌথ বিবৃতি

লেখক ও প্রকাশক হত্যায় জড়িতদের শাস্তি দাবি করে মঙ্গলবার ৩৮ জন বুদ্ধিজীবী যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। সংবাদমাধ্যমে পাঠানো কামাল লোহানী স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, “অপরাধীদের খুঁজে বের করে বিচার না করার ফলে হত্যাকারীরা উৎসাহিত হচ্ছে।”

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বর্তমান সময়ে সংঘটিত প্রকাশক ও লেখকদের হত্যা দেশজুড়ে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। মুক্তবুদ্ধির জাগরণকে রুদ্ধ করতে সাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠী একের পর এক এ ধরনের হত্যা চালিয়ে যাচ্ছে।

“গত এক বছরে পাঁচজন লেখককে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলেও সরকার এখনো পর্যন্ত একটি হত্যাকাণ্ডেরও বিচার করতে পারেনি।অপরাধীদের খুঁজে বের করে বিচার না করার ফলে হত্যাকারীরা উৎসাহিত হচ্ছে, বলা হয় বিবৃতিতে।

যে সকল অপরাধীকে ধরা হয়েছে তারাও জামিনে ছাড়া পেয়ে আবারও তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে সরকারের এরূপ উদাসীনতা মুক্তবুদ্ধির মানুষদের হতাশ করেছে বলে বিবৃতিতে বলা হয়।

“দেশকে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ধারায় এগিয়ে নিতে সরকার চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপরই বর্তায়,” মনে করিয়ে দেন তাঁরা।

তাঁরা বলেন, “সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে খুনিদের আইনের আওতায় আনার বদলে লেখকদের সংযত হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে খুনিদের চেয়েও বেশি অপরাধী হচ্ছে লেখালেখি করা। আমরা এ অবস্থাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না।”

“আমরা মনে করি, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা সংবিধান স্বীকৃত ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে এ ধরনের কালাকানুন থাকতে পারে না। অবিলম্বে ৫৭ ধারা বাতিল করতে হবে,” দাবি তোলেন তাঁরা।

বিবৃতিদাতা ৩৮ জন হলেন আহমেদ রফিক, প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কামাল লোহানী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক যতীন সরকার, ড. অজয় রায়, হাসান আজিজুল হক, সৈয়দ হাসান ইমাম, শাহরিয়ার কবির, রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, বেগম মুশতারী শফি, ড. অনুপম সেন, অধ্যাপক মাহফুজা খানম, সেলিনা হোসেন, অধ্যাপক কাজী মদিনা, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, আবুল মোমেন, লায়লা হাসান, সুজেয় শ্যাম প্রমুখ।


উত্তরায় ১১ ‘জেএমবি সদস্য’ আটক

নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি’র সদস্য সন্দেহে ঢাকার উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার ১১ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দিনের হেফাজতে পেয়েছে পুলিশ । ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আলমগীর কবির মঙ্গলবার পুলিশের রিমান্ড আবেদনের শুনানি নিয়ে তাদের হেফাজতে নেওয়ার আদেশ দেন ।

এরা হলেন; আরিফ ইবনে খায়ের ওরফে রিফাত, মো. বাবু মুন্সী ওরফে মাসুদ রানা, মো. খোরশেদ আলম, ওমর ফারুক, মো. আলহাজ মিয়া, মো. হেলাল উদ্দিন, আব্দুল বাছেদ, মো. সুজাত, আজাহার আলী, মো. ফরহাদ হোসেন ও মিজানুর রহমান।

গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক আবদুর রাজ্জাক বিকালে ওই ১১ জনকে আদালতে হাজির করে প্রত্যেককে ১০ দিনের রিমান্ডে চেয়ে আবেদন করেন।

আসামিদের পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকায় বিচারক তাদের কোনো বক্তব্য আছে কি না তা জানতে চান।

জবাবে তারা বলেন, তাঁরা জেএমবি সদস্য নন। গত ১ নভেম্বর বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের আটক করা হয়।

জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্য বলে তথ্য থাকায় সোমবার রাতে ঢাকার উত্তরা পশ্চিম থানার আব্দুল্লাহপুর এলাকা থেকে এই ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে মঙ্গলবার দুপুরে জানায় গোয়েন্দা পুলিশ।

গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু উগ্রপন্থী বই, বিস্ফোরক দ্রব্য ও দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয় বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।