সন্ধ্যা ৬ টার মধ্যে ব্যাংকের নারীকর্মিদের ছুটি
2015.06.02
মঙ্গলবার। মতিঝিল ব্যাংক পাড়া। সন্ধ্যা ছয়টা ১০ মিনিট। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে দলে দলে নারী ব্যাংক কর্মীরা বেরিয়ে আসছেন। দিন শেষে খোশ মেজাজে তাদের এভাবে বের হওয়া সচরাচর চোখে পড়ে না।
জানা গেল, বিকাল চারটার পরে ব্যাংকগুলোর লেনদেনের সময় শেষ হলেও ব্যাংকের কাজ শেষ করে থেকে বের হতে কয়েকদিন আগেও রাত আটটা বাজত কর্মীদের। সেটা নারী হোক কিংবা পুরুষ।
হঠাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নির্দেশনায় সে দৃশ্যপট বদলেছে। ছয়টার পরপরই ব্যাংক ছাড়া শুরু করেছেন কর্মীরা। এতে করে ভীষণ খুশি তারা।
যৌক্তিক কারণ ছাড়া ব্যাংক কর্মকর্তাদের ছাঁটাই বন্ধ ও ব্যাংকিং সময়সূচীর পরে কর্মীদের ব্যাংকে থাকা বাধ্যতামূলক না করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশেষ করে নারী কর্মীদের সন্ধ্যা ছয়টার পর আর না রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে তা পাঠানো হয়েছে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে। এ খবরে কর্তাদের কারো কারো কপালে ভাঁজ পড়লেও খুশি হয়েছেন ব্যাংক কর্মীরা। বিশেষ করে নারীরা।
জানা গেছে, এছাড়া ব্যাংকের সময়সূচি অনুযায়ী সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অফিস করার কথা থাকলেও বাড়তি কাজের জন্য তাদের অনেক বেশি সময় ধরে ব্যাংকে রাখা হত। অনেক সময় নারী কর্মকর্তাদের রেখে নানা হয়রানির ঘটনা ঘটানো হচ্ছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অভিযোগও আসে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন নির্দেশনায় ‘যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছি’ বলে জানালেন একটি বেসরকারী ব্যাংক কর্মী মাহফুজা আক্তার।
মতিঝিল এলাকায় দাঁড়িয়ে তিনি বেনারকে বলেন, …বিশেষ করে আমরা মেয়েরা ভীষণ খুশি হয়েছি। কারণ, যে হারে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়ছে, সেভাবে তাদের জন্য নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা হয়নি। তাছাড়া পারিবারিক, সামাজিক কিছু দায়িত্বও আমাদের পালন করতে হয়। রাত আটটায় ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যেটা কখনই সম্ভব হয়ে উঠে না। কর্মস্থলে ডে কেয়ার সেন্টার না থাকায় দীর্ঘ সময় শিশুদেরকে বাড়িতে রেখে মায়েদের কাজ করতে হয়। এছাড়া আমাদের অনেক নারী কর্মী সন্ধ্যার পর কাজ করতে গিয়ে পুরুষ সহকর্মীদের অসদাচণের শিকার হয়েছেন। এসব বিবেচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য ‘বিরাট এক পুরস্কার’।”
“এর আগে এসব কারণে আমার অনেক নারী সহকর্মী চাকরি ছেড়েছেন।” যোগ করেন তিনি।
মাহফুজা বলেন, “বলা হয় ব্যাংক কর্মীদের সকাল ১০টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত কর্মঘণ্টা। অথচ কোন দিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় অফিস থেকে বেরুনোর অনুমতি চাইলে স্যার ( উর্ধ্বতন কর্মকর্তা) বলতেন, এখনই! অনেক সময় তিনি কোন উত্তরই দিতেন না!”
মাহমুদা নামের আরেকটি বেসরকারী ব্যাংক কর্মী বেনারকে বলেন, সারাদিন পরিশ্রম করে সন্ধ্যা ছটার পরে মাথায় আসলে আর কিছু থাকে না। কোন কাজে মনোযোগ দেওয়া যায় না।
তিনি বলেন, যতটুকু না কাজের চাপ, তার চেয়ে সিস্টেমের সমস্যার কারণে আমাদেরকে রাত পর্যন্ত আটকে রাখা হত। ওদিকে বাসায় ছোট বাচ্চা রেখে আসি আমরা। সে বিষয়টিও মানতে রাজি হত না ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
মতিঝিল শাপলা চত্ত্বরে বাসের জন্য অপেক্ষারত নার্গিস আক্তার নামে এক বেসরকারী ব্যাংক কর্মী বলেন, “বলা হত বেসরকারী ব্যাংকে সকালে প্রবেশের জন্য নির্ধারিত সময় আছে, কিন্তু বেরুনোর জন্য নেই। সে করূণ অবস্থা থেকে আমাদেরকে মুক্ত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নির্দেশনা। তবে ছ’টার পরপরই বেরুনোর বিষয়ে বেসরকারী ব্যাংকগুলোর কর্মর্তারা জানিয়েছেন, ইচ্ছে করলেই ছ’টার পর যে কেউ অফিস থেকে বেরুতে পারেন, তবে অবশ্যই তাকে নিজের কাজ শেষ করে বেরুতে হবে।
এ বিষয়ে মাহফুজা বলেন, বেসরকারী ব্যাংকগুলোতে কাজের চাপের তুলনায় লোকবাল এত কম যে, তিনজনের কাজ একজনকে দিয়ে করানো হয়। এ কারণে ছটার মধ্যেই সব কাজ শেষ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবু যাতে অন্ধকার হওয়ার আগেই গন্তব্যে পৌঁছাতে পারি, সেজন্য যত দ্রুত সম্ভব কাজ শেষ করার চেষ্টা করি।
জানা যায়, বিভিন্ন ব্যাংক কোন ধরনের কারণ ছাড়াই কর্মকর্তাদের ছাঁটাই করছে। অনেক সময় কোন কর্মকর্তা অন্য ব্যাংকে যাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে পদত্যাগপত্র দিলে তা গ্রহণ না করে কোন একটি কারণ দেখিয়ে তাকে বরখাস্ত করা হচ্ছে। এর ফলে চাকরি পরবর্তী সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কর্মকর্তারা। এতে ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিককালে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, ব্যাংকিং সময়সূচির পরে কার্যদিবস শেষে কর্মকর্তা-কর্মচারী বিশেষ করে নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে ব্যাংকে অবস্থানের জন্য বাধ্য করা হচ্ছে। তাছাড়া, তফসিলী ব্যাংকের কর্মকর্তাগণের নিকট হতে চাকরিতে ইস্তফা, অযৌক্তিক বরখাস্ত বা অপসারণ এবং পরবর্তী আর্থিক সুবিধা প্রাপ্তিতে হয়রানিসহ বিভিন্ন বিষয়ে অসংখ্য অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে। এতে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা তৈরি হচ্ছে যা সুষ্ঠু মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অন্তরায়।
এখন এ মর্মে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, ব্যাংকিং সময়সূচির পরে অর্থাৎ সন্ধ্যা ৬ টার পরে কর্মকর্তা-কর্মচারী বিশেষ করে নারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীদেরকে ব্যাংকে অবস্থানের জন্য বাধ্য করা যাবে না। বিশেষ প্রয়োজনে যদি কোন নারী কর্মীকে ব্যাংকিং সময়সূচীর পরেও ব্যাংকে অবস্থান করতে হয় তবে তাদেরকে উপযুক্ত নিরাপত্তা ও পারিশ্রমিক প্রদান করতে হবে।
এতে আরও বলা হয়েছে, ব্যাংক থেকে ইচ্ছামাফিক ঢালাওভাবে কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাঁটাই বন্ধ করতে হবে। নিয়োগের সময় পেশাদারিত্বের সঙ্গে প্রার্থী যাচাই-বাছাই করতে হবে। নিয়োগকৃত কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। এছাড়া কর্মকর্তাদের চাকরিতে ইস্তফা, চাকরি হতে বরখাস্ত বা অপসারণ এবং পরবর্তী আর্থিক সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক শ্রমিক আইন, বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ ও সময়ে সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেয়া নির্দেশনা যথাযথভাবে পালন করতে হবে।
দিদারুল আলম নামে উত্তরা এলাকার একটি বেসরকারী ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, “কিছুদিন ধরে ব্যাংকে ছাটাই আতঙ্ক চলছে। আমরা যারা ডেস্কে কাজ করি তাদেরকেও গ্রাহক যোগাড় করতে বলা হচ্ছে। আর কাজের চাপ তো আছেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দশনায় এখন কিছুটা হলেও চাপ মুক্ত হব। কিন্তু আদৌ ছয়টার পর পরই বেরুতে পারব কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।”
এসব নির্দেশনার বিষয়ে বেসরকারী বাণিজ্যিক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল কুদ্দুস বেনারকে বলেন, শুধু নারী নয় কোন কর্মীকেই সময়ের অতিরিক্ত জোরপূর্বক আটকে রাখতে চাইনা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মোতাবেক কোন কর্মী ছয়টার পরেই অফিস ছাড়তে পারবেন। তবে তাকে অবশ্যই তার কাজ শেষ করে যেতে হবে। এটি তার দায়িত্ব।
“সকাল থেকে মনোযোগ দিয়ে কাজ করলে কোন কাজ পড়ে থাকার কথা নয়।” মন্তব্য করেন তিনি।
এছাড়া লোকবল বাড়াতে ব্যাংকগুলোতে নিয়মিত নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকিং খাতে মোট ব্যাংকের সংখ্যা ৪৭টি। এসব ব্যাংকগুলোতে পুরুষের পাশাপাশি নারী কর্মীদের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। বলা চলে ব্যাংকিং খাতে নারীদের সংখ্যা বাড়ছে। তবে এর কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই।