এবার ব্লগার নিলয়কে হত্যা, দায় স্বীকার আনসার আল ইসলামের

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.08.07
BD-blogger ব্লগার নিলয়কে হত্যার পর তার স্ত্রী আশামনি কান্নায়-শোকে বর্ননা করেন লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের। ৭ আগষ্ট,২০১৫
এএফপি

আপডেটঃ ২৮ আগষ্ট,২০১৫

বাংলাদেশে ব্লগারদের লাশের মিছিলে যুক্ত হল আরো একটি নাম, খুন হলেন ব্লগার নিলয় নীল। শুক্রবার প্রকাশ্য দিবালোকে ভাড়াটিয়া পরিচয়ে বাসায় ঢুকে তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তার আসল নাম নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় (৪০)। এ হত্যার দায় স্বীকার করেছে আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের (এআইকিউএস) বাংলাদেশ শাখা আনসার আল ইসলাম।

সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ প্রকাশ্যে রাস্তায় খুন হওয়ার পর তিন মাস না পেরোতেই ঢাকায় ব্লগার নিলয় খুনের ঘটনা ঘটল। তিনি ব্লগে ও ফেসবুকে ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লেখালেখি করতেন। নিলয় যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে আন্দোলন ও গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন। এছাড়া তিনি ছিলেন বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিলেরও সদস্য।

মহানগর পুলিশের খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া বেনারকে বলেন, “উত্তর গোড়ান টেম্পো স্ট্যান্ডের কাছে একটি পাঁচতলা ভবনের পঞ্চম তলার বাসায় গত দুই বছর ধরে নিলয় চক্রবর্তী বসবাস করে আসছিলেন। শুক্রবার ছুটির দিনের দুপুরে জুমার নামাজ শেষ হওয়ার পরপরই ওই বাসাতে হত্যাকান্ডটি ঘটে।”

‘আল্লাহু আকবর শ্লোগান দিয়ে হত্যা’

প্রায় বছর দু’য়েকের বিবাহিত জীবন ছিল নিলয়ের। তার স্ত্রী আশামনি হত্যাকান্ডটির বর্ণনা দেন এভাবে- “দুপুর ১২টার দিকে আমার স্বামী বাজার থেকে ফিরে ল্যাপটপ নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসেন। এমন সময় হঠাৎ কলিং বেল বাজে। আমি দরজা খুলতেই ২০-২১ বছর বয়সী জিন্সের প্যান্ট পরা এক যুবক  বাসায় ঢোকেন। তিনি বাসা ভাড়া নেবেন বলে নিজ থেকেই দু’বার পুরো ফ্ল্যাট ঘুরে দেখেন। কিন্তু আমি বলি, ‘আমরা তো বাসা ছাড়ছি না, বাসা ভাড়া নেবেন কীভাবে? বাড়িওয়ালাও তো এ বিষয়ে কিছু জানাননি।’

এসময় ওই যুবক বলেন, ‘বাড়িওয়ালাই আমাকে দেখে যেতে বলেছেন।’ একথা বলার সময় তার হাতে থাকা মোবাইলে কী যেন করছিলেন ওই যুবক। আমি বিষয়টি ড্রয়িংরুমে আমার স্বামীকে জানাতে যাই। এরইমধ্যে আরও তিন যুবক বাসায় ঢোকেন। তাদের একজনের মুখে দাঁড়িও ছিল। ভেতরে ঢুকেই তারা দরজা বন্ধ করে দেন। তিনজন যুবকের হাতে রামদা ও একজনের হাতে পিস্তল ছিল।”

স্বামীর শোকে বারবার মূর্ছা যাওয়া আশামনি বলেন, “একজন আমার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বারান্দায় রেখে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। একইভাবে আমার ছোটবোন তন্বী, যে অন্যরুমে ছিল; তাকেও সেখানে আনা হয়। পরে এক সঙ্গে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে আমার স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা করে চলে যায় তারা। বারান্দায় আমি বারবার ‘বাঁচাও, ‘বাঁচাও’ বলে চিৎকার দিলেও কেউ এগিয়ে আসেনি।”

যুব মৈত্রীর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আশামনি আরও বলেন, “অতীতেও এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কিন্তু বিচার হতে দেখিনি। বিচার হলে আজ আমাকে স্বামী হারাতে হতো না।”  নিজেকেও ‘নিরাপত্তাহীন’ মনে করছেন  বলে জানান তিনি।

হত্যার ধরণ একই, পরিকল্পিত বলছে পুলিশ

ব্লগার হত্যার ঘটনাগুলো দেখে পুলিশ বলছে, হত্যাকারীরা মূলত: শরীরের উপরের অংশগুলোকে টার্গেট করে থাকে।

নিলয় হত্যার পর ঘটনাস্থলে পরিদর্শেনে এসে গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় সাংবাদিকদের বলেন, “এর আগে অন্য ব্লগারদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, নিলয় হত্যাকাণ্ডের ধরণও একই রকম। তার গলা ও ঘাড়ে এলোপাতাড়ি কোপের চিহ্ন রয়েছে। যা অন্যান্য ব্লগার হত্যার ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা গেছে।”

ব্লগার হত্যার সব ঘটনার মত এ ঘটনাটিও পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করে কৃষ্ণপদ রায় বলেন, “জুমার নামাজের সময় যখন আশেপাশের বাসার পুরুষরা নামাজে গেছেন, হত্যাকারীরা সেই সময়টিকেই বেছে নিয়েছে।”

আল কায়েদার দায় স্বীকার

এদিকে ব্লগার নিলয় হত্যার দায় স্বীকার করেছে আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের (এআইকিউএস) বাংলাদেশ শাখা আনসার আল ইসলাম। ansar.al.islam.bd @gmail. com ইমেইল ঠিকানা থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে জঙ্গি সংগঠনটি।

প্রেরক হিসেবে আনসার আল ইসলামের মুখপাত্র মুফতি আব্দুল্লাহ আশরাফের নাম লেখা ইমেইলটিতে বলা হয়, “আনসার আল ইসলাম (আল কায়েদা ভারতীয় উপমহাদেশ, বাংলাদেশ শাখা) এর মুজাহিদিনরা হামলা চালিয়ে আল্লাহ তা'আলা ও তার রাসুলের দুশমন নিলয়কে হত্যা করেছেন। শুক্রবার দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে ওই অপারেশন সম্পন্ন হয়।”

এতে বলা হয়, “আল্লাহর রাসুলের সম্মান রক্ষার্থে প্রতিশোধমূলক ওই হামলা চালানো হয়েছে।”

বিবৃতির শেষে বলা হয়, 'যদি তোমাদের বাক স্বাধীনতা কোনও সীমানা না মানতে প্রস্তুত থাকে তবে তোমাদের হৃদয় যেন আমাদের চাপাতির স্বাধীনতার জন্য উন্মুক্ত থাকে।'

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ শাখার উপকমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “ব্লগার নিলয় হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। আনসার আল ইসলামের দায় স্বীকারের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”


ফেসবুকে ঠিকানা বদলেছিলেন নিলয়

সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার নিলয় নীল ‘ইস্টিশন’ ব্লগে লেখালেখি করতেন। নিলয়ের পরিবার ও বন্ধুদের সূত্রে জানা যায়, নিয়মিত ব্লগার হত্যার মাঝে গত কিছুদিন ধরে তিনিও হুমকি পেয়ে আসছিলেন। এ কারণে ফেইসবুক থেকে নিজের সকল ছবি সরিয়ে ফেলেন তিনি। এছাড়া সেখানে বর্তমান ঠিকানা বাংলাদেশের পরিবর্তে ভারতের কলকাতার নাম যুক্ত করেন।   


নিরাপত্তা চাওয়ায় বিদেশ যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল পুলিশ  

গত মে মাসে নিলয় লক্ষ্য করছিলেন মাঝে মাঝে তাকে কেউ অনুসরণ করছে। তিনি পুলিশের কাছে নিরাপত্তাও চেয়েছিলেন। কিন্তু নিরাপত্তা নয়, পলিশ তাকে দ্রুত দেশ ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে গত ১৫ মে নিলয় নিজ ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছিলেন –“ আমাকে দুজন মানুষ অনুসরণ করেছে গত পরশু। ‘অনন্ত বিজয় দাশ হত্যার’ প্রতিবাদে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে যোগদান শেষে আমার গন্তব্যে আসার পথে এই অনুসরণটা করা হয়।”

ওই ঘটনায় জিডি করতে গেলেও থানা তা নেয়নি বলে ওই পোস্টে লিখেছিলেন তিনি।

“অনেকগুলো থানা অতিক্রম করার জন্য গতকাল ঘটনাস্থলের আওতায় থাকা একটি থানায় গেলে তারা জিডি নিল না, তারা বললো আমাদের থানার অধীনে না, এটা অমুক থানার অধীনে পড়েছে ওখানে যেয়ে যোগাযোগ করুন, আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশ ছেড়ে চলে যান।”


বইছে নিন্দার ঝড়

এদিকে নিরাপত্তা চাওয়ার পরেও একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষকে নিরাপত্তা না দেওয়া এবং ব্লগার হত্যাকারীদের আইনের আওতায় না আনতে পারায় আইনশৃঙ্খলাবাহিনী এবং সরকারের সমালোচনা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে বইছে নিন্দার  ঝড়। আর ইসলামি চিন্তাবিদরা বলছেন, ইসলাম বিকাশ বা প্রচারের নামে যারা ব্লগার হত্যা করছে তারা ইসলামের শত্রু।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসা গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বেনারকে বলেন, “নিলয় মঞ্চের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ব্লগে নিয়মিত তিনি সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী লেখা লিখতেন। ব্লগার হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে না পারার ব্যর্থতার কারণেই ব্লগার হত্যা বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই ব্লগার হত্যাকারীদের উৎসাহ দিচ্ছে বলে আমি মনে করি।”

ফেসবুকে অনাদৃত অর্ক নামে একজন লিখেছেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, দেশ ছেড়ে চলে যান!' কারণ,এই দেশ আপনার জন্য না। অনলাইন লেখকদের মারলে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি লাভ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই!

তিনি আরো লেখেন,  “অনেকে আমার সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। কিন্তু একটু ভেবে দেখুন-কারা চাপাতির কোপে যুক্তিবাদীদের শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করছে এ তো সবারই জানা। তাহলে এদের ধরা হচ্ছে না কেন? কারণটাও খুব পরিষ্কার-লেখকরা মারা গেলে মানুষের সব ক্ষোভ তো গিয়ে পড়বে মৌলবাদীদের উপর। আওয়ামীলীগ ভালো করেই জানে- যতই সমালোচনা করেন না কেন -ঘুরে ফিরে আপনাকে তো লীগের পতাকাতলেই আসতে হবে”।

ইসলামি চিন্তাবিদ মুফতি এনায়েতুল্লাহ বেনারকে বলেন, “ইসলাম কোনভাবেই কোন ধরনের হত্যাকান্ডকে সমর্থন করে না। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন- একজন মানুষকে হত্যা পুরো মানবগোষ্ঠীকে হত্যার নামান্তর"।

তিনি আরো বলেন, "এছাড়া বুখারি শরিফে বলা আছে- কেয়ামতের দিন প্রথম শুরু হবে হত্যাকাণ্ডের বিচার। সুতরাং যারা ইসলাম প্রচারের নামে বা ইসলামকে বিকশিত করার জন্য ব্লগার বা অন্যান্য হত্যা চালাচ্ছে তা কোনভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। কোন ধরনের রক্তপাতকে ইসলাস সমর্থন করে না। এমনকি ইসলামের শেষ নবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) যুদ্ধের সময়েও কোন নিরীহদের আঘাত করেননি। এমনকি ফলবান বৃক্ষকে কাটতেও নিষেধ করে গেছেন তিনি। তাই ইসলামের দোহাই দিয়ে যারা ব্লগার হত্যা করছে তারা অ-ইসলামকে আমন্ত্রণ করছে।”

এদিকে ব্লগার নিলয় হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। পাশাপাশি নিলয়সহ অন্যান্য ব্লগার হত্যার দ্রুত বিচারও চেয়েছে সংস্থাটি।

 

সংশোধণঃ ভুলক্রমে প্রথমে নীলাদ্রি চক্রবর্তী নাম ছাপা হয়, তাঁর প্রকৃত নাম নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।