ব্লগার নিলয় ও অনন্ত হত্যায় জড়িত কয়েকজন আটক ও রিমান্ডে
2015.08.28
ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে বৃহস্প্রতিবার ঢাকার পুলিশ আরো দুজনকে এবং শুক্রবার সিলেটে অনন্ত হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত সন্দেহভাজন ২ সহদরকে আটক করেছে সিআইডি। ঢাকার দু’জনকে শুক্রবার পাঁচ দিনের এবং সিলেটের দু’জনকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
এই নিয়ে নিলয় হত্যায় জড়িত সন্দেহে আটকের সংখ্যা দাঁড়াল চার জনে। আটকৃতরা নিষিদ্ধ ঘোষিত আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য বলে মনে করছে পুলিশ, যারা আরো একজন ব্লগারকে হত্যা চেষ্টার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিও।
২৭ আগষ্ট সন্ধ্যার পর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মিরপুর ১০ নম্বর থেকে কাউছার হোসেন খান (২৯) এবং শ্যামপুরের ধোলাইপাড় থেকে কামাল হোসেন সরদারকে (২৯) গ্রেফতার করা হয়।
গোয়েন্দা পুলিশের উপ কমিশনার (মিডিয়া) মুনতাসিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “এই দুই যুবক আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য বলে আমরা মনে করছি।”
গ্রেফতারের একদিন পর শুক্রবার আদালতে হাজির করে তাদেরকে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দশ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। রিমান্ড শুনানি শেষে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এদিকে এই দুই যুবকই ব্লগার আসিফ মহীউদ্দীনকে হত্যাচেষ্টা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি বলে নিশ্চিত করেছেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (পূর্ব) মাহবুব আলম।
তিনি জানান, ওই ঘটনায় তারা দুজন গ্রেফতার হয়েছিলেন। পরে জামিনে মুক্ত হন।
গত ৭ আগস্ট ঢাকার গোড়ানে নিজের বাসায় সন্ত্রাসীদের ধারলো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হন ব্লগার নিলয়। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে গত ১৩ আগস্ট সাদ আল নাহিন ও মাসুদ রানা নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এদের মধ্যে নাহিন শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুর ভাতিজা।
২০১৩ সালে উত্তরায় আসিফ মহীউদ্দীনের উপর হামলার অভিযোগে নাহিনও গ্রেফতার হয়ে এক বছরের বেশি সময় কারাবাসের পর জামিনে ছাড়া পান।
ওই হত্যাচেষ্টা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক নিবারণ চন্দ্র বর্মন জানান, নাহিন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সক্রিয় সদস্য বলে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছিলেন।
নিলয় হত্যার পর গণমাধ্যমে পাঠানো ইমেইলে এর দায় স্বীকার করে আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের (একিউআইএস) বাংলাদেশ শাখা আনসার আল ইসলাম। তবে পুলিশ এ সংগঠনটির কোন অস্তিত্ব এখনো খুঁজে পায়নি। তাদের সন্দেহ, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।
পুলিশের তৎপরতা দাবি আশামনির
ঘটনার ২১দিনের মধ্যে চারজন আসামিকে আটক করা হলেও পুলিশের কার্যক্রমে সন্তুষ্ট নয় নিলয়ের স্ত্রী আশামনি, যার সামনেই নিলয়কে হত্যা করা হয়।
তিনি বেনারকে বলেন, “ছয় মাসের মধ্যে চারজন ব্লগার খুন হয়েছেন। যদি প্রথম থেকেই পুলিশ তৎপর থাকত, তাহলে এতগুলো নিষ্পাপ প্রাণ ঝরে যেতো না। আটক করার পরেও এসব অপরাধীরা জামিনে ছাড়া পাচ্ছে, যা পুলিশ ও প্রশাসনের গাফিলতি প্রমাণ করে। শুধুমাত্র ইচ্ছা থাকলেই পুলিশ এসব ব্লগার হত্যাকারীদের আটক করে আইনের আওতায় আনতে পারে।”
আশামনি বলেন, “নিলয় হত্যায় জড়িত সন্দেহে আরো দুজনকে আটকের খবর শুনেছি। এর আগের দুজনকে (নাহিন ও মাসুদ) আটক করার পর তাদেরকে সনাক্ত করতে পুলিশ আমাকে ডেকেছিল। কিন্তু সেদিনের (হত্যাকান্ডের) ঘটনার আকস্মিকতায় আমি ঘাতকদের চেহারা মনে রাখতে পারিনি। তবে আমি মনে করি পুলিশ তৎপর এবং আন্তরিক হলে শুধু নিলয় নয়, সকল ব্লগার হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব।”
‘ম্যাজিক নেই পুলিশের কাছে’
এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুলিশ বলছে, আমরা আসামিদের আটক করার জন্য তৎপরতা চালাচ্ছি। কিছুদিন পর পরই কয়েকজন করে জঙ্গি আটক করছে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী। আটকের পর তাদেরকে সাংবাদিকদের সামনে আনা হলেও তাদেরকে এসব বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ দেয়া হয় না। ফলে সাধারণ মানুষও পুলিশের ‘জঙ্গি ধরা’ কার্রক্রমের শিকার হতে পারেন- বলে নানা সমালোচনা আছে।
তবে সেসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে পুলিশ। মোনতাসিরুল বলেন, “অভিযোগকারীরা পুলিশের কার্যক্রম সঠিকভাবে না জেনেই এমন অভিযোগ আনছেন। আমরা তথ্যের ভিত্তিতে আটক করি। অপরাধ প্রমাণ না হলে বা প্রমাণ করতে আমরা ব্যর্থ হলে তাদের নাম অভিযোগপত্রে আনিনা। ফলে স্বাভাবিক নিয়মে অভিযুক্তরা মুক্তি পেয়ে যায়।”
এ বিষয়ে সাবেক পুলিশ পরিদর্শক নুরুল হুদা বেনারকে বলেন, পুলিশের কাছে কোন ম্যাজিক নেই। নির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতেই তারা সন্দেহভাজন আসামিদেরকে আটক করে। পরে তথ্য যাচাই বাছাই করে যদি তারা নির্দোষ প্রমাণিত হন তখন আদালত থেকে তারা ছাড়া পেয়ে যান। সারা পৃথিবী জুড়ে এটাই অপরাধী ধরা বা অপরাধ দমনের নিয়ম।”
এছাড়া আগের তুলনায় দেশে জঙ্গির সংখ্যা বাড়ছে উল্লেখ করে সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের কারণেই দেশে জঙ্গির সংখ্যা বাড়ছে। সেইসঙ্গে পুলিশও অনেক তৎপর। ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড পরিচালনাকারী এসব জঙ্গিরা বিভিন্ন নামে তাদের কার্যক্রম চালায়। সে কারণে তাদের একাধিক নাম থাকতে পারে। কিন্তু পুলিশ কাজ করে তথ্যের ভিত্তিতে। তাই নাম বদলালেও পুলিশকে তারা অন্ধকারে রাখতে পারে না।”
ব্লগার অনন্ত বিজয় হত্যায় আটক আরো দুই জন
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ব্লগার অনন্ত বিজয় হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ২ সহদরকে আটক করেছে সিলেট মহানগর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সদস্যরা।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাদের আটক করা হয় বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন সিলেট মহানগর পুলিশের এডিসি রহমত উল্লাহ। পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে আটকৃতদের ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন সিলেটের একটি আদালত।
গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা হলেন সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার পূর্ব পালজুর গ্রামের মান্নান ইয়াহিয়া ওরফে মান্নান রাহী ও মোহাইমিন নোমান ওরফে এএএম নোমান।
এর আগে এ মামলায় ইদ্রিস আলী নামে স্থানীয় এক ফটোসাংবাদিকে আটক ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
১২ মে সিলেটের সুবিদবাজার এলাকার নিজ বাসা থেকে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে মুক্তমনার ব্লগার ও সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক অনন্তকে কয়েকজন মুখোশধারী কুপিয়ে হত্যা করে। ঘটনার দিনই নিহতের বড়ভাই অজ্ঞাতনামা চার জনকে আসামি করে বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা করেন।