ব্লগার হত্যা মামলাগুলোর অগ্রগতি নেই

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.11.02
BD-blogger ব্লগার আশিকুর হত্যায় আটক জিকুল্লাহ ও আরিফুল ইসলাম।
বেনার নিউজ

প্রফুল্ল। একটি ভবনের নাম, যার একটি ফ্লাটে সপরিবারে বসবাস করতেন ঢাকায় দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ফয়সাল আরেফিন দীপন। দুদিন আগেও যে প্রফুল্লে হাসি-আনন্দে দিন কাটত দীপন পরিবারের, সেখানে এখন কান্নার সুর, বিষাদের ছাপ।

এই বিষন্ন প্রফুল্লের মত অবস্থা প্রায় প্রতিটি নিহত ব্লগার পরিবারের। এই পরিবারের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। দুর্বৃত্তদের হাতে অকালে প্রাণ দিচ্ছেন মুক্ত চিন্তার মানুষ। ঘটনার পর নিয়ম করে মামলা হচ্ছে, আটকও হচ্ছে দু-চারজন সন্দেহভাজন। কিন্তু বিচার হচ্ছে না কোন মামলারই।

এসব মামলার অগ্রগতি-সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথি বলছে, গত তিন বছরে সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন সাতজন ব্লগার, যার মধ্যে গত নয় মাসে হত্যা করা হয়েছে পাঁচজনকে। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আহমেদ রাজীব হায়দারকে দিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের শুরু। আর গত শনিবার সর্বশেষ শিকার হলেন জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ফয়সাল আরেফিন দীপন। প্রত্যেকটি ঘটনার মামলা হলেও কোনটারই বিচার ও তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই।


৩৩ মাসে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যন্ত অগ্রগতি রাজীব হত্যার বিচারের

২০১৩ সালের  ১৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন চলাকালে নিজ বাসার সামনে দুর্বৃত্তের চাপাতির আঘাতে খুন হন ওই আন্দোলনের সক্রিয়কর্মী আহমেদ রাজিব হায়দার। সে ঘটনার ৩৩ মাস কেটে গেলেও এখন পর্যন্ত সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে আছে মামলাটি। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩-এ বিচারাধীন মামলাটিতে এ পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষের ৫৫ সাক্ষীর মধ্যে ১৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী তারিখ দেওয়া হয়েছে আগামী ৮ নভেম্বর।

ঘটনার পর জড়িত সন্দেহে পুলিশ সাতজনকে আটক করে। ২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারি জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানীসহ আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এদের মধ্যে জসীম উদ্দিনসহ সাতজন কারাগারে আছেন। রেদোয়ানুল আজাদ রানা (৩০) নামে একজন এখনো পলাতক। রাজীব হায়দার ব্লগে ‘থাবা বাবা’ নামে লেখালেখি করতেন।


এখনো অভিজিৎ হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারেনি পুলিশ

চলতি বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে একুশের বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়কে, মারাত্মক আহত হন তার স্ত্রী রাফিদা বন্যা আহমেদ। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলা হয়। মামলার সন্দেহভাজন আসামি আটজন। হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ২ মার্চ যাত্রাবাড়ী থেকে শফিউর রহমান ওরফে ফারাবী নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে ডিবিতে হস্তান্তর করে র‍্যাব।

সর্বশেষ ১০ সেপ্টেম্বর র‍্যাব-৩-এর সহায়তায় গ্রেপ্তার করা হয় আসামি জুলহাস বিশ্বাস, জাফরাফ হাসান ও আবুল বাসারকে। ব্লগার অনন্ত বিজয় হত্যা মামলার আসামি মান্নান রাহীকে এ মামলাতেও আসামি করা হয়েছে, গত ২৭ সেপ্টেম্বর যাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়।

এরপর থেকে এ মামলার আর কোনো অগ্রগতি জানা যায়নি। মামলাটিতে সাতজনকে গ্রেফতার দেখানো হলেও আজ পর্যন্ত  আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি পুলিশ। এমনকি এ বিষয়ে কথা বলতেও তাদের আপত্তি। ‘মামলাটি তদন্তাধীন আছে’-এর বাইরে একটি কথাও বলতে রাজি হননি তদন্ত কর্মকর্তা ফজলুর রহমান। অভিজিত হত্যার পর তদন্তে সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের একটি প্রতিনিধি দলও ঢাকায় এসেছিল।


হাতেনাতে আসামি ধরিয়ে দিলেও ওয়াশিকুর হত্যা বিচারের গতি শ্লথ

অভিজিৎ হত্যার এক মাসের মধ্যেই গত ৩০ মার্চ রাজধানীর তেজগাঁওয়ে রাস্তার দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে আরেক ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে। ঘটনার পর পালানোর সময় কয়েকজন হিজড়া, স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ মিলে জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলাম নামের দুজনকে ধরে ফেলেন। এদের একজন পরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।

এ মামলায় পাঁচজনকে আসামি করে গত ১ সেপ্টেম্বর পুলিশ অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে।  যাদের তিনজন বর্তমানে কারাগারে আটক, বাকি দুজন পলাতক রয়েছেন। পলাতক দুজনের সম্পত্তি ‘ক্রোক’ করারও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। ঢাকার সিএমএম আদালতে চলা মামলাটি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।


অগ্রগতি নেই সিলেটের ব্লগার বিজয় হত্যা মামলার

গত ১২ মে সকালে সিলেটের সুবিদবাজারের নুরানি আবাসিক এলাকায় খুন হন ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ। এই ‘মুক্তমনা’ ব্লগার সিলেট থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞান বিষয়ক একটি পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন। ঘটনার দিন রাতে এলাকার বিমানবন্দর থানায় হত্যা মামলা হয়। সপ্তাহ তিনেক পর মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) স্থানান্তর করা হয়। তদন্তে নেমে সিআইডি ইদ্রিস আলী নামের স্থানীয় এক ফটোসাংবাদিককে আটক করে রিমান্ডে নেয়।

এখন পর্যন্ত চারজনকে গ্রেফতার ও অন্য মামলায় আগেই আটক নয়জনকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। আসামি মান্নান রাহী ও মোহাইমিন নুমানকে ২৭ আগস্ট সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ২ সেপ্টেম্বর মান্নান রাহী ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। রাহী বলেছেন, তিনি এবং আরও তিনজন ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

এ মামলার আটজন আসামি অভিজিত হত্যা মামলারও আসামি। সূত্র বলছে, আদালতে প্রয়োজনীয় নথি উপস্থাপন করতে না পারায় এখনো মামলার শুনানি শুরু হয়নি। আর ‘হত্যাকারীরা শনাক্ত’ উল্লেখ করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জানান, “…তবে অভিযোগপত্র জমা দিতে কিছুদিন সময় লাগবে।” এদিকে গত ২৮ অক্টোবর ইদ্রিস আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে গেছে।


চাপা পড়ছে নীলাদ্রি হত্যা মামলা

চলতি বছরের ৭ আগস্ট রাজধানীর খিলগাঁওয়ে খুন হন ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয় নীলকে। এ মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে আটক চারজনের মধ্যে দুজনকে গত ২৭ আগস্ট ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। এরপর থেকে আর কোন অগ্রগতি হয়নি মামলাটির। যেন একের পর আরেক ব্লগার হত্যার ঘটনায় চাপা পড়েছে নীল হত্যাকান্ড মামলা। তেমন কোনো অগ্রগতি নেই বলেও জানান তদন্ত কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান। তিনিও বলেন, “আটকৃতদের দেওয়া তথ্য ধরে তদন্ত কাজ চলছে।”


বিচারাধীন আরও দুই মামলা

এছাড়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আরিফ রহমান হত্যা ও ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন হত্যাচেষ্টা মামলায় করা দুটি মামলাও বিচারাধীন রয়েছে। গত ২০১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি রাজধানীর উত্তরায় ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। পরের পছর ২০১৪ সালে ৩১ ডিসেম্বর মামলাটির অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। তারপর থেকে মামলাটি আদালতে বিচারাধীন।

একই বছরের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আরিফ রহমানকে হত্যা করা হয়। ২০১৪ সালের ১৬ মার্চ অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তিকে আসামি করে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া মামলাটিও এখন আদালতে বিচারাধীন।

প্রকৃতপক্ষে, ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় এই মুক্তমনা লেখক ও ব্লগারদের উপর হামলা। সেদিন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলা চলাকালীন সময়ে ধর্মান্ধদের হামলায় গুরুতর আহত হন লেখক-অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ।

এরপর কয়েক মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর ২০০৪ সালের আগস্টে গবেষণার জন্য জার্মানিতে যান এই লেখক। পরে ১২ অগাস্ট মিউনিখে নিজের ফ্ল্যাট থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রায় এক যুগ ১১ বছর পার হয়ে গেলেও হত্যাকান্ডটির বিচার কাজ শেষ হয়নি। এখনও সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে মামলাটি।

৭ মে পর্যন্ত এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ৫৮ সাক্ষীর মধ্যে ৩৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। মামলায় কারাগারে আটক রয়েছেন জেএমবির শুরা সদস্য আনোয়ার আলম ওরফে ভাগ্নে শহিদ ও হাফিজ মাহমুদ। অপর দুই আসামি মিজানুর রহমান ওরফে মিনহাজ ওরফে শফিক ও সালেহীন ওরফে সালাহউদ্দিনকে গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি ছিনিয়ে নেয় জঙ্গিরা। তাদের অনুপস্থিতিতেই মামলার কার্যক্রম চলছে।


প্রতিটি ঘটনার দায় স্বীকার ধর্মীয় মৌলবাদীদের

এসব হত্যাকান্ডের প্রত্যেকটির জন্যই কোনো না কোনো ধর্মীয় এবং মৌলবাদী সংগঠন দায় স্বীকার করেছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলোই পুলিশের সন্দেহের তালিকায় রয়েছে। তবে ঘটনার পরপরই রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যকে দোষারোপ শুরু করেছে।  সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বারবার ‘তদন্ত চলছে, আসামি ধরা পড়বে, বিচার হবে’ এমন বক্তব্যই আসছে। কিন্তু বাস্তবে  বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা আর নতুন খুনের ঘটনা একটি আরেকটিকে চাপা দিচ্ছে। ফলে কোন ব্লগার হত্যার বিচারই এখনো আলোর মুখ দেখেনি বলা যায়।

বিচারহীনতায় হতাশ স্বজনরা

ব্লগার বা মুক্ত মনের লেখক হত্যার বিচারের এই দশা পরিবার ও স্বজনদের মাঝে হতাশাই ছড়াচ্ছে। যে কারণে প্রকাশক দীপন হত্যার পর তার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, ‘আমি কোনো বিচার চাই না।’

এই একই কথা বলেছেন নিহত ব্লগার অভিজিতের স্ত্রী বন্যা আহমেদও। তিনি ব্লগে লিখেছেন, “দীপনের বাবার মতো আমিও বিচার চাইনা”।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।