বিএনপির সমশের মবিনের অবসরে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন
2015.10.29
বিএনপির সব পদ থেকে সরে দাঁড়িয়ে রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সমশের মবিন চৌধুরী, যিনি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের খুবই ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন ।
এমন এক সময়ে প্রভাবশালী ওই নেতা দল ও রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দিলেন, যখন সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙা করতে ব্যর্থ হয়ে কঠিন এক সময় পার করছে বিরোধী দল বিএনপি।
সামরিক কর্মকর্তা থেকে আমলা, পরে বিএনপির রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা এই নেতার হঠাৎ অবসর স্বাভাবিক মনে করছেন না বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনেকে।
“এটা ‘অপ্রত্যাশিত কিছু নয়’। তবে তিনি দলে থাকলে ভালো হতো, থাকতে না পারলে কি করা যাবে,” বেনারকে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
নজরুল ইসলাম বলেন, “তিনি তো আমাদের মতো তৃণমূল রাজনীতি করেননি। অসুস্থ হলেও আমাদের মতো পারবেন না। জেলে ছিলেন, বের হয়ে আসার পর যোগাযোগও রাখতেন না। নেতা-কর্মীরা এর জন্য প্রস্তুত ছিল।”
চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি সমশের মবিন চৌধুরীকে তাঁর বনানী ডিওএসএইচের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা আছে। তিন মাস কারাভোগের পর গত ২২ মে তিনি জামিনে মুক্তি পান। এরপর থেকে সমশের মবিনকে বিএনপির কোনো কর্মকাণ্ডে দেখা যায়নি।
শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে লেখা এক চিঠিতে অবসর নেওয়ার ঘোষণা দেন।
খালেদা জিয়াকে লেখা পদত্যাগ পত্র
গত বুধবার রাতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মাধ্যমে দলের চেয়ারপারসন বরাবর চিঠিটি পাঠান শমসের মবিন। চিঠি দেওয়ার দিন থেকে তিনি আর বিএনপির কোনো পদে থাকছেন না বলেও উল্লেখ করেন।
“আমি যুদ্ধাহত একজন মুক্তিযোদ্ধা। শারীরিকভাবে এখন আর রাজনীতি করার মতো অবস্থায় নেই। এ কারণে বিএনপির সব পদ থেকে পদত্যাগ করে অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন থেকেই তা কার্যকর হবে,” বেনারকে জানান সমশের মবিন।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে লেখা চিঠিতে সমশের বলেন, ‘আপনি নিশ্চয় অবগত আছেন, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমি গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলাম। সে কারণে আমাকে বিভিন্ন সময় দেশে বিদেশে নানাবিধ চিকিৎসা নিতে হয়েছে। বর্তমানে আমার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে। আমার বর্তমান স্বাস্থ্যগত অবস্থার কারণে আমি অনতিবিলম্বে রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
সংক্ষিপ্ত ওই চিঠিতে সমশের আরও লেখেন, “একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার স্বাস্থ্যগত সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে সামনে রেখে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করার প্রয়াস আমার চিরকাল থাকবে।”
সমশের মবিন বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। তিনি একাত্তরে সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট পদে ছিলেন। পরে সেনাবাহিনী থেকে তিনি পররাষ্ট্র দপ্তরে নিয়োগ পান।
দ্বিতীয় মেয়াদে বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় তিনি পররাষ্ট্রসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। কূটনীতিক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতও ছিলেন। ২০০৮ সালে বিএনপি চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হন।
২০০৯ সালে বিএনপির কাউন্সিলে তিনি দলের ভাইস চেয়ারম্যান হন। কখনো নির্বাচনে অংশ না নিলেও গত কয়েক বছর তিনি বিএনপির মূল ক্ষমতাকেন্দ্রের খুব কাছাকাছিই ছিলেন।
দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে লন্ডনে যাওয়ার পর থেকে সেখানে বড় ছেলে তারেক রহমানের কাছেই অবস্থান করছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতেই দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা অবসরে গেলেন।
চলতি বছরের শুরুতে বিএনপি ও শরিকদের টানা অবরোধ-হরতালের মধ্যে নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার হন সমশের মবিন। গত মে মাসে জামিনে মুক্তি পেলেও এর পর আর তাকে রাজনীতিতে খুব বেশি সক্রিয় দেখা যায়নি।
নজরুল ইসলাম খান মনে করেন, মিথ্যা মামলায় জেলে মানসিক চাপে ছিলেন। শারীরিক অসুস্থতার জন্যও হয়তো এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে মধ্যে ‘অন্য কোনো চিন্তা’ আছে বলে তিনি মনে করেন না।
সমশের মবিনকে অভিনন্দন: হানিফ
বিএনপি থেকে বিবেকবান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী আরও অনেক নেতা বেরিয়ে আসবেন বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম সমশের মবিন চৌধুরী দলটি থেকে পদত্যাগের ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এ বক্তব্য এলো।
গতকাল বৃহস্পতিবার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক যৌথসভায় দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ এ কথা বলেন।
“সন্ত্রাস ও নাশকতা সৃষ্টিকারী বিএনপি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমরা তাঁকে স্বাগত ও অভিনন্দন জানাই,” বলেন হানিফ।
হানিফ বলেন, “আপনারা জেনে খুশি হবেন যে বিএনপির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে, হতাশা ব্যক্ত করে আজ বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সমশের মবিন চৌধুরী দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। আমার বিশ্বাস বিএনপির মধ্যে এখনো যাঁরা বিবেকবান মানুষ আছেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, তাঁরা প্রত্যেকেই এই দল থেকে বেরিয়ে আসবেন।
ওই চিঠিতে তিনি যা লিখেছেন, তা পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-
মান্যবর,
বেগম খালেদা জিয়া
মাননীয় চেয়ারপার্সন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)
মাননীয় চেয়ারপার্সন,
আমার সালাম ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করিবেন।
আপনি নিশ্চয় অবগত আছেন, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমি গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলাম। সে কারণে আমাকে বিভিন্ন সময় দেশে-বিদেশে নানাবিধ চিকিৎসা নিতে হয়েছে। বর্তমানে আমার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে।
আমার বর্তমান স্বাস্থ্যগত অবস্থার কারণে আমি অনতিবিলম্বে রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
অবসর গ্রহণের প্রেক্ষিতে আমি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সকল পদ থেকেও পদত্যাগ করলাম।
একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার স্বাস্থ্যগত সীমাবদ্ধতার মধ্য থেকে মুক্তিযোদ্ধার মূল্যবোধকে সামনে রেখে দেশ ও জাতীয় কল্যাণে কাজ করার প্রয়াস আমার চিরকাল থাকবে।
আপনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
ধন্যবাদন্তে
(সমশের এম চৌধুরী, বীর বিক্রম)
ঢাকা, বাংলাদেশ।