বৌদ্ধ স্থাপত্যকে ঘিরে আরো বেশি পর্যটকের অপেক্ষায় বাংলাদেশ
2015.10.27
দক্ষিণ এশিয়া ও এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিষ্ট স্থাপত্য, স্থাপত্য শৈলী ও নিদর্শনের উন্নয়ন বা বিকাশের লক্ষ্যে বাংলাদেশে দুদিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন শুরু হয়েছে, যার লক্ষ্য বাংলাদেশকে বুদ্ধিষ্ট সার্কিটের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা।
সরকার আশা করছে, বুদ্ধের স্থাপত্যকে ঘিরে যে পর্যটকেরা এই অঞ্চলে আসেন, তাঁদের নতুন গন্তব্য হবে বাংলাদেশ। সম্মেলনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে পর্যটন বর্ষ-২০১৬ ঘোষণা করেছেন।
“আমরা আশা করছি, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ দেশে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়বে,” বেনারকে জানান বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব খোরশেদ আলম চৌধুরী।
তিনি জানান, বিশ্বে সুপরিচিত বুদ্ধিষ্ট টুরিজম বিশেষজ্ঞ এবং দেশীয় টুরিজম প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনার পর দক্ষিণ এশিয়ায় সমন্বিত আন্তসীমান্ত বুদ্ধিষ্ট টুরিজম সার্কিট ও রুটের উন্নয়ন এবং মার্কেটিং পরিকল্পনার জন্য রোডম্যাপ তৈরি করা এই সম্মেলনের মূল লক্ষ্য।
জনশ্রুতি রয়েছে, খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে গৌতম বুদ্ধ এ দেশে আগমন করেন। তিনি প্রায় তিন মাস অবস্থান ও ধর্মপ্রচার করেন। পরবর্তীতে সম্রাট অশোকের শাসনামলে বিহার, মূর্তি ও স্তম্ভ নির্মাণ, সম্রাট কণিষ্কের সময়ে বৌদ্ধধর্মের প্রসার, পঞ্চম থেকে সপ্তম শতকে চীনা পরিব্রাজকদের এ দেশে আগমন এবং অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত পাল রাজত্বকালে বাঙালির জীবন ও সংস্কৃতিতে বৌদ্ধধর্মের গভীর প্রভাব বিস্তার করে।
যে সব দেশ অংশ নিচ্ছে
ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থার (ইউএনডাব্লিউটিও) সহযোগিতায় বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ‘ডেভেলপিং সাস্টেইনএ্যাবল অ্যান্ড ইনক্লুসিভ বুদ্ধিষ্ট হেরিটেজ অ্যান্ড প্রিলিগ্রিমজ সার্কিট ইন সাউথ এশিয়ান বুদ্ধিষ্ট থাইল্যান্ড’ শীর্ষক এ সম্মেলনের আয়োজন করে।
আয়োজক বাংলাদেশসহ বৌদ্ধ জনসংখ্যা অধ্যুষিত ১৩টি দেশ চীন, জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ভুটান, নেপাল, ভারত ও শ্রীলঙ্কার পর্যটন মন্ত্রীবৃন্দ, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ এবং পর্যটন সংশ্লিষ্ট অন্যান্যরা এ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন।
সম্মেলন উদ্বোধন করতে গিয়ে বাংলাদেশের হাজার বছরের বৌদ্ধ সংস্কৃতির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ অঞ্চলের বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যভিত্তিক পর্যটন বিকাশে সবাইকে কাজ করার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, “বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রাচীনকালের নান্দনিক স্থাপত্যকলা বাংলাদেশের সমৃদ্ধ পর্যটনের ইতিহাসের এক বিশেষ অধ্যায়। এ ইতিহাস আড়াইহাজার বছরব্যাপী বিস্তৃত।”
এই সম্মেলন বুদ্ধিষ্টদের সঙ্গে আঞ্চলিক দেশগুলো বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, ভারত ও শ্রীলঙ্কার টুরিজম পরিচালনাকারীদের মধ্যে একটি প্লাটফরম গড়ে তুলতে সহায়ক হবে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা, অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা, হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পের জন্য খুবই সম্ভাবনাময়। বিশ্ব মানচিত্রে একটি নতুন পর্যটন গন্তব্য হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার জন্য এ দেশে প্রয়োজনীয় সব ধরনের উপদানই রয়েছে।”
তিনি বলেন, “আমার কাছে গোটা দেশই যেন এক বিশাল পর্যটন ভূমি। ষড়ঋতুর সম্ভারে নানারকম বৈচিত্র্য, সমতল ভূমি, হাওর-বাঁওড়, পাহাড়, টিলা আর ছায়া সুনিবিড় গ্রামগুলো নান্দনিক উৎকর্ষে যে কারও হৃদয় কাড়ে।”
বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ ফারুক খান ও ইউএনডব্লিউটিও মহাসচিব ড. তালেব রিফাই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন। মন্ত্রীবৃন্দ, সংসদ সদস্য, কূটনীতিক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
যে সব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পর্যটন শিল্পের সার্বিক উন্নয়ন এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে একটি পর্যটন গন্তব্য হিসেবে প্রচারের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার জাতীয় পর্যটন নীতিমালা-২০১০ ঘোষণা করেছে। তিনি বলেন, পর্যটন আইন, ২০১০-এর মাধ্যমে জাতীয় পর্যটন সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ টুরিজম বোর্ড (বিটিবি) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ৬০টি দেশের জন্য অন-অ্যারাইভাল ভিসা সুবিধা প্রবর্তনের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বর্তমান সরকার পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে টুরিস্ট পুলিশ প্রতিষ্ঠা করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে কক্সবাজার জেলার সাবরাং-এ ১০২৮ একর জমির ওপর বিশেষ পর্যটন অঞ্চল (ইটিজেড) গড়ে তোলার কার্যক্রম দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে।
শেখ হাসিনা সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে পর্যটকসহ যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে সম্প্রতি বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল (বিবিআইএন) ‘মোটর ভেহিক্যাল এগ্রিমেন্ট’ (এমভিএ) চুক্তি স্বাক্ষরের কথা উল্লেখ করে বলেন, এর ফলে আন্তর্দেশীয় পর্যটকদের গমনাগমন বৃদ্ধি পাবে এবং এ অঞ্চলের পর্যটন শিল্প দ্রুত বিকশিত হবে।
বাংলাদেশ টুরিজম বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, পাহাড়পুর, ময়নামতিসহ বাংলাদেশে অন্তত ৫০০ বৌদ্ধ স্থাপনা আছে। মহাস্থানগড়ের বসু বিহার, রাজশাহীর সোমপুর বিহার, কুমিল্লার শালবন বিহার, চট্টগ্রামের পণ্ডিত বিহার, ঢাকার বিক্রমশিলা বিহার উল্লেখযোগ্য।
“২০১৪ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার, নেপাল ও মিয়ানমারে বৌদ্ধধর্মীয় পর্যটনস্থান ভ্রমণের সংখ্যা ছিল ৪৮ লাখ। ২০২০ সালের মধ্যে এসব অঞ্চলে প্রায় এক কোটি পর্যটককে আনার লক্ষ্য আছে দেশগুলোর,” বেনারকে জানান ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) পরিচালক মাসুদ হোসেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ যদি আগামী পাঁচ বছরে এই পর্যটকের মধ্যে মাত্র দেড় শতাংশ ধরতে পারে, এতেও শুধু এই পর্যটকের সংখ্যা হবে দেড় লাখ।