স্বাস্থ্য ও শিক্ষার চেয়ে প্রতিরক্ষা খাত গুরুত্ব পাওয়ায় বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট ঘিরে সমালোচনা হচ্ছে। উন্নয়নশীল, জনবহুল ও দারিদ্রকবলিত দেশটির স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অগ্রগতি চূড়ান্তভাবে জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে পারে বলে শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের ধারণা।
গত ৪ জুন জাতীয় সংসদে পেশ করা ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলিয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। এটা গত প্রস্তাবিত বাজেটের চেয়ে ১ হাজার ৯২১ কোটি বেশি।
বাজেট বিশ্লেষকেরা দেখেছেন, আগামী বছরের মোট বাজেট ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার মধ্যে প্রতিরক্ষা বাজেট ৬ দশমিক ২ শতাংশ। প্রতিরক্ষার চেয়ে কম বরাদ্দ স্বাস্থ্য খাতের, যা বাজেটের ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এবারে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির ২.১৬ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশে নেমেছে।
"বাংলাদেশের মতো দেশের উচিত জাতীয় বাজেটে দারিদ্র্য নিরসন, খাদ্য নিরাপত্তা, মানব সম্পদ উন্নয়নের দিকে বেশি নজর দেওয়া। এটা করতে হলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে," বেনারকে জানান দুর্নীতি-বিষয়ক পর্যবেক্ষক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
তাঁর মতে, সামরিক বাহিনী অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ, এর পেশাদারি ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ হিসেবে প্রতিরক্ষা খাতে অস্বাভাবিক বাজেট বাড়ানো বা অস্ত্র রপ্তানিকারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া দেশটির ভাবমূর্তির সংকট বাড়াতে পারে।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা আধুনিকায়নের কথাও বলেছেন । কিন্তু বরাদ্দ বাড়িয়েছেন কম।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ৫ জুন বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন করে কৃষি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমে যাওয়ায় কঠোর সমালোচনা করেছে।
প্রতিরক্ষা বাজেট: চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রতিরক্ষা খাতে মূল বরাদ্দ ছিল ১৬ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। সে হিসাবে আগামীবারের জন্য ১ হাজার ৯২১ কোটি টাকা বেশি প্রস্তাব করা হয়েছে।
যদিও মূল বাজেট থেকে সংশোধন করে চলতি অর্থবছরে এ খাতের বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হয় ১৭ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। এই অঙ্ককে ভিত্তি ধরলে আগামীবারের জন্য প্রতিরক্ষা খাতে বেশি প্রস্তাব করা হয়েছে ৬১৩ কোটি টাকা।
বাজেট সংক্ষিপ্তসারে দেখা যায়, আগামীবারের জন্য এ খাতের অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। আর উন্নয়ন ব্যয় ৪১৬ কোটি টাকা।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) ২০১২ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৮৮-২০১১ সময়ে প্রতিরক্ষা খাতে বাংলাদেশের ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১২ গুণ। এ খাতের ব্যয় ১৯৮৮ সালের ১ হাজার ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা।
বাজেট পেশের আগের দিন অর্থমন্ত্রী এক প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, "প্রতিরক্ষা খাতের বাজেট নিয়ে আমাদের দেশে পাকিস্তানি প্রথা বা ট্র্যাডিশনের একটি ধারাবাহিকতা চলছে। এ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হতেও কোনো অসুবিধা নেই।"
তবে অর্থমন্ত্রী এ কথা বললেও প্রতিরক্ষা বাজেট নিয়ে সে অর্থে অন্যান্য খাতের মতো আলোচনা-পর্যালোচনা হয় না।
বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, "উন্নত প্রশিক্ষণ, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও প্রযুক্তিনির্ভর সমরসম্ভার সংগ্রহ এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধা বাড়ানোর মাধ্যমে সেনা, নৌ, বিমান ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সামর্থ্য ও কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করছে সরকার। ইতিমধ্যে জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতির একটি খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। অচিরেই তা চূড়ান্ত করা হবে।"
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। গত প্রায় অর্ধযুগ পার হলেও এটি চূড়ান্ত হয়নি।
সাবেক আমলা আবুল মাল আবদুল মুহিতই তাঁর ১৯৯১ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ পুনর্গঠন ও জাতীয় ঐকমত্য গ্রন্থে (৩৯-৪০ পৃষ্ঠা) মত প্রকাশ করেন "দেশের সম্পদের একটি বিরাট অংশ সামরিক অপব্যয়ে উবে যায়।" একই গ্রন্থের ৬৬ পৃষ্ঠায় তিনি বলেন, "বাজেট বরাদ্দে সামরিক খাতে অনেক লুক্কায়িত খরচও সংযোজিত হয়।"
সেই আমলা এখন অর্থমন্ত্রী হলেও প্রতিরক্ষা বাজেটের ধরন এতটুকু পাল্টায়নি। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত রাজনৈতিক ঐকমত্যের সন্ধানে গ্রন্থেও জনাব মুহিত লেখেন, "প্রতিরক্ষা প্রস্তুতিতে মূল্যবান সম্পদের অপচয় হচ্ছে, বিনিয়োগের জন্য সঞ্চয় থাকছে না।"
অর্থমন্ত্রী ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সামরিক ব্যয় বাড়ানোর বিপক্ষে বক্তৃতা করেছেন অতি সম্প্রতি। গত ৩০ মে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়া খাদ্য অধিকার সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সব দেশের সামরিক ব্যয় কমানোর মাধ্যমে বিশ্ব থেকে দারিদ্র্য সমূলে উৎপাটন সম্ভব।
ওই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, "সমরসজ্জার পেছনে যে ব্যয় হয়, তার একটু অংশ যদি দারিদ্র্য দূর করার জন্য ব্যয় হতো, তাহলে আর বিশ্বে দারিদ্র্য থাকত না।"
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, "২০১২ সালে বিশ্বের সম্মিলিত সামরিক ব্যয় ছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার কোটি (১.৭৬ ট্রিলিয়ন) ডলার। ওই বছরে বিশ্বে সামরিক খাতে ব্যয় ছিল বিশ্বের মোট জিডিপির ২.৫ শতাংশ। মাথাপিছু ব্যয় ছিল ২৪৯ ডলার।"
একইসঙ্গে শেখ হাসিনা জানান, বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা দূর করতে প্রতি বছরে ৩০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। ২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর ৮ দিনের ব্যয় ৩০ বিলিয়ন ডলার।
এর মাত্র এক সপ্তাহ আগে ২১ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-প্রতিরক্ষা সমরাস্ত্র আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানির ওপর মনোযোগী হওয়ার জন্য সামরিক বাহিনীকে নির্দেশ দেন।
গত বছরের মে মাসে সরকারি-মালিকানাধীন অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা (বিওএফ) তাদের তৈরি অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিদেশে রপ্তানি করার জন্য সরকারি ছাড়পত্র চেয়েছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এটা করতে চাইলে সরকারকে অবশ্যই দেশের রপ্তানি নীতিমালা সংশোধন করতে হবে। এই নীতিমালা অনুযায়ী বর্তমানে অস্ত্র ও গোলাবারুদ রপ্তানি করা নিষিদ্ধ।
যদিও গত ৩০ বছরে "অস্ত্র ছাড়া বাকি সবকিছু" রপ্তানি করার নীতিই বাংলাদেশের রপ্তানি নীতিমালার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল, কিন্তু বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা এখন সেটা পরিবর্তন করার আশা করছে।
স্বাস্থ্য বাজেটে কাটছাঁট: নতুন অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১২ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা । আগের অর্থবছরে তা ছিল ১১ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা ।
সিপিডি দেখিয়েছে, ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার মোট বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের অংশ মাত্র ৪ দশমিক ৩১ শতাংশ । অথচ বিদায়ী ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বরাদ্দ ছিল ৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ । আবার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ একই রকম আছে, দশমিক ৭৪ শতাংশ । পাঁচ বছর আগেও স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ছিল জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ ।
"বাজেট দেখে মনে হয় স্বাস্থ্যের দিকে সরকারের কোনো নজর নাই, মনোযোগ নাই । এই বরাদ্দে চিকিৎসা নিতে মানুষের পকেটের খরচ বাড়বে । আর দরিদ্র রোগীদের সেবা পাওয়া কঠিন হবে," বেনারকে জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহ-উপাচার্য অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব ।
"বাজেটে সবচেয়ে অবহেলিত খাতের একটি হচ্ছে স্বাস্থ্য," বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে জানান সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ।
শিক্ষা বাজেটে কার্পণ্য: এবারে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির ২ শতাংশ । আগের অর্থবছরে তা ছিল ২ দশমিক ১৬ । ইউনেসকোর সুপারিশ হচ্ছে, শিক্ষা খাতে একটি দেশের বরাদ্দ হওয়া উচিত জিডিপির ৬ শতাংশ । অর্থাৎ অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ ।
প্রস্তাবিত বাজেটে টাকার অঙ্কে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ বেড়েছে । শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাদ্দ পেয়েছে ১৭ হাজার ১০৩ কোটি টাকা । চলতি অর্থবছরে তা ছিল ১৫ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা ।
আর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৪ হাজার ৫০২ কোটি টাকা । চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে তা ১৩ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা । এবারের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি এক করে দেখানো হয়েছে । সব মিলিয়ে এই খাত বরাদ্দ পেয়েছে ৩৪ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা ।
অথচ বাজেট বক্তৃতায় মাধ্যমিক শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার কথা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, প্রথমেই বলতে হবে, প্রাথমিক শিক্ষার পরেই অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে । দ্বিতীয়ত, মাধ্যমিক শিক্ষায় মানসম্মত শিক্ষকের অভাব খুবই প্রকট । তৃতীয়ত, এই স্তরে শিক্ষার মান বেশ নিম্ন পর্যায়ে আছে । বক্তৃতায় গুরুত্ব পেলেও বরাদ্দে গুরুত্ব পেল না এই শিক্ষা খাত ।
"শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া উচিত-এ কথা সবার মতো সরকারও বলে । কিন্তু সরকারকে সেটা প্রমাণ করতে হবে । আনুপাতিক হার ও পরিমাণ-দুই দিক থেকেই শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে," বেনারকে জানান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।
কৃষিতে দুরবস্থা: সিপিডির পর্যালোচনা অনুযায়ী, দুরবস্থা কৃষি খাতেও । ২০০৯-১০ থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত মোট বাজেটে সামগ্রিক কৃষি খাতের অংশ ছিল ১০ দশমিক ৩ শতাংশ । প্রস্তাবিত বাজেটে তা নেমে হয়েছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ । বরাদ্দের বড় অংশই ভর্তুকি ।
এদিকে, নতুন অর্থবছরে ব্যয়ের সবচেয়ে বড় খাত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বেতন-ভাতা। মোট বরাদ্দের ২৩ শতাংশই খরচ হবে সরকারি চাকরিজীবীদের নতুন বেতনকাঠামো বাস্তবায়নে ।
এর আগে সুদ পরিশোধ ছিল বরাদ্দের সবচেয়ে বড় খাত, প্রায় সাড়ে ১৮ শতাংশ । আর এক বছর আগেও বেতন-ভাতায় ব্যয় হয়েছে ১৭ শতাংশ ।
"বাংলাদেশে বেতন-ভাতা ও সুদ পরিশোধের মতো অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় অনেক বেশি বেড়ে যাওয়ায় কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর বরাদ্দ কমছে," বাজেট বিশ্লেষণ করে এ কথা জানিয়েছে সিপিডি।