মা-ই ঘাতক!
2016.03.03
মা আর ঘাতক। শব্দ দুটোর যেন চির শত্রুতা। ঘাতকের হাত থেকে সন্তানকে রক্ষাই তো মায়ের ধর্ম! কিন্তু চিরন্তন সে ধর্ম ভুলে একজন মা-ই তার দু’সন্তানকে খুন করেছেন। মা-ই ঘাতক!
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রামপুরায় দুই ভাই-বোন তাদের মায়ের হাতে খুন হয়েছেন বলে দাবি করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জিজ্ঞাসাবাদে সেকথা তিনি স্বীকার করেছেন বলে জানিয়েছে র্যাব। তারা বলছেন, সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে ‘দুশ্চিন্তার’র কারণেই নিজের ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে ছেলে-মেয়েকে হত্যা করেন মা মাহফুজা মালেক জেসমিন।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি নিজ বাসায় ঘুমন্ত অবস্থায় মারা যায় ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইস্কাটন শাখার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ইশরাত জাহান অরণী (১৪) এবং তার ছোটভাই হলি (ইন্টারন্যাশনাল) ক্রিসেন্ট স্কুলের নার্সারির ছাত্র আলভী আমানকে (৬)। শুরুতে পরিবার খাবারে বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর কথা বলা হলেও ময়নাতদন্তে হত্যার আলামত পাওয়ার ঘটনাটি নতুন মোড় নেয়। এরপর শিশুটির বাবা, মা, খালাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে র্যাব। এরপরদিনই দুই শিশু হত্যার বিষয়টি পরিস্কার হল।
দুশ্চিন্তা থেকে সন্তান হত্যা!
বৃহস্পতিবার সাংবাদিক সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান জানান, “হত্যার রহস্য উন্মোচনে শিশু দুটির বাবা-মা ও খালাকে জামালপুরের বাড়ি থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। সাবধান ও সংবেদনশীলতার সঙ্গে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে শিশু দুটির মা মাহফুজা মালেক পরিকল্পিতভাবে সন্তানদের হত্যার কথা স্বীকার করেন।”
হত্যার কারণ জানতে চাইলে মাহমুদ খান বলেন, “মাহফুজা জানান, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ও ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন তিনি। তিনি ভাবতেন ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে কিছুই করতে পারবে না। সেই দুশ্চিন্তা থেকেই তিনি ছেলেমেয়েকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন।”
জিজ্ঞাসাবাদের সময় নিহত অরনী ও আলভীর মা মাহফুজাকে সুস্থ ও স্বাভাবিক দেখেছেন জানিয়ে মুফতি মাহমুদ খান বলেন, মাহফুজা ‘মানসিকভাবেও সুস্থ ছিলেন’।
তবে ওই ঘটনায় দুই শিশুর বাবা পোশাক ব্যবসায়ী আমানুল্লাহর সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ মেলেনি বলে র্যাব জানায়।
যেভাবে সন্তানদের হত্যা করেন মাহফুজা
সংবাদ সম্মেলনে মাহমুদ খান মাহফুজার বর্ননা থেকে জানান হত্যাকাণ্ডের বিবরণে বলেন, “গত ২৯ ফেব্রুয়ারি মেয়ে অরণী গৃহ শিক্ষকের কাছে পড়ছিল। এসময় তার মা ও ভাই শোবার ঘরে ঘুমাচ্ছিলেন। পড়ানো শেষে গৃহ শিক্ষক চলে যাওয়ার পর নিজের কাছে মেয়েকে ঘুমাতে ডাকেন মাহফুজা। মায়ের ডাকে অরণী যাওয়ার পর মাহফুজা তার ওড়না পেঁচিয়ে মেয়েকে শ্বাসরোধ করেন। এসময় ধস্তাধস্তিতে অরনী বিছানা থেকে পড়ে যায়। পরে মেয়ের মৃত্যু নিশ্চিত হলে ঘুমন্ত ছেলেকেও একইভাবে ওড়না পেঁচিয়ে খুন করেন মা মাহফুজা।
এরপর খুনের ঘটনা ধামাচাপা দিতে স্বামীকে ফোন করে ছেলেমেয়ের অসুস্থতার কথা জানায়। সন্তানদের অসুস্থতার খবরে উদ্বিগ্ন আমানুল্লাহ তখন বাসায় তার দুই বন্ধুকে পাঠায়। তাদের সহযোগিতায় অরনী ও আলভীকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তবে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
চাইনিজ রেস্তোরাঁ থেকে আনা খাবারে বিষক্রিয়ার কথা বলে মাহফুজা খুনের কারণ ঢাকতে চেয়েছিলেন।
র্যাবের মুখে শিশু দুটির মায়ের স্বীকারোক্তি পাওয়ার কথা নিশ্চিত হওয়ার পর স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তাদের বাবা আমানুল্লাহ। বৃহস্পতিবার রামপুরা থানায় রাত ১০টায় তিনি বাদী হয়ে হত্যা মামলাটি দায়ের করেন।
ওই মামলায় শিশুদের মা মাহফুজা মালেক জেসমিনকেই একমাত্র আসামি করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন রামপুরা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোস্তাফিজুর রহমান।
অবিশ্বাস্য
র্যাব কর্মকর্তা মুফতি মাহমুদ খান বলেন, মায়ের হাতে সন্তান হত্যার মত ঘটনা আমরাও বিশ্বাস করতে পারিনি। তবে জিজ্ঞাসাবাদে এসব জানতে পেরেছি।
মায়ের হাতে সন্তান খুনের এই ঘটনা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে অনেকেরই।
সাজ্জাদ খান নামে একজন অপরাধ বিষয়ক রিপোর্টার তার ফেসবেুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, “পৃথিবীতে সব চেয়ে বড় নিরাপদ স্থান মায়ের কোল। শিশু পরম নির্ভরতায় ঘুমায় মায়ের বুকে। মায়েরা নিজের সব সুখ-স্বপ্ন নি:শেষ করে দেয় সন্তানদের জন্য। কোন মা-বাবাই যখন সন্তানদের গলাটিপে হত্যা করে তখন বুঝতে হবে সমাজে বড় ধরণের পচন ধরেছে। ক্যান্সার হওয়ার আগেই এই পচন সারিয়ে তুলতে হবে।”
দুই শিশু সন্তানের মা নিজ হাতে সকল মায়েদেরকে সন্তানদের কাছে অসস্তিতে ফেলে দিয়েছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আইনুদ সনি নামে একজন মা নিজেই প্রশ্ন তুলেছেন-“আমরা মায়েরাও কি বাচ্চাদের জন্য নিরাপদ নই?”
দুই শিশু হত্যার ঘটনার নতুন এই মোড় চমকে দিয়েছে সমাজবিজ্ঞানীদেরও। সমাজের অস্থির প্রতিযোগিতা, আইনের শাসনের অভাব আর হীনমন্যতাকে এমন ঘটনার জন্য দায়ী করেছেন তারা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বেনারকে বলেন, “সমাজে অস্থির প্রতিযোগিতা চালু হয়েছে। ছেলেমেয়েরা বিরাট কিছু হবে- সেটা শিশু বয়স থেকেই যেন তাদেরকে প্রমান দিতে হবে। অরনী ভিকারুন্নেসা স্কুলের মত বিখ্যাত স্কুলের ছাত্রী ছিল। সেখানে ভর্তির সুযোগ পাওয়া মানে, সে কম মেধাবী তা নয়। সুতরাং ভবিষ্যত নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করার কোন কারণ ওই মার ছিল না। সমাজের এই অস্থির প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শিশু সুরক্ষার বিষয়ে ক্যাম্পেইন করতে হবে।”
তবে এর জন্য সামাজিক পরিবর্তনকে অনেকাংশে দায়ী করেন অপরাধবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান। তিনি বেনারকে বলেন, “আকাশ সংস্কৃতি, পাশ্চাত্য মূল্যবোধগুলো আংশিক বা বিকৃতভাবে গ্রহণ করার কারণে সমাজে এক ধরনের পরিবর্তন ঘটছে। মানুষ একসঙ্গে একাধিক সম্পর্কে জড়াচ্ছে। সেসব চাপা দিতে অনেক সময় মা সন্তানদের, আবার সন্তান বাবা-মাকে হত্যার মত নৃশংস ঘটনা ঘটছে। সামাজিক ন্যায়বিচার, সামাজিক অনুশাসন মেনে চললে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব।”