ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ধর্ষিতা শিশু ভর্তির সংখ্যা বাড়ছে

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.06.09
BD-child দেশে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা বাড়ছে,বিপদ থেকে সুরক্ষার জন্য শিশুদের সচেতন করে গড়ে তোলার কথা বলছে অনেকে। মার্চ,২০১৫
বেনার নিউজ

সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি কর্মসূচির আওতায় ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) থেকে ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুরা জরুরি স্বাস্থ্য সেবা ও আইনগত পরামর্শ পেয়ে থাকে। ওই সেন্টারের তথ্য পরিসংখ্যান বলছে, সেখানে আসা ধর্ষিত শিশুর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।

ওসিসির তথ্য অনুযায়ী, সেখানে ২০০৯ সালে তাদের কাছে এসেছিল ১৮টি ধর্ষিত শিশু। ২০১০ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৬। ২০১১ সালে সংখ্যাটি এক শ ছাড়িয়ে যায়। ২০১২ সালে তা হয় ১৩৫।

আর এ বছরের প্রথম চার মাসে ওসিসিতে এসেছে ৪৯টি শিশু।

“কয়েক বছরের পরিসংখ্যান বলছে, ধর্ষিত হয়ে ওসিসিতে আসা শিশুর সংখ্যা অস্বাভাবিক বাড়ছে। অবশ্য সব শিশু এই কেন্দ্রে আসে না,” বেনারকে জানান ওসিসির মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের পরিচালক আবুল হোসেন।

দিনমজুর আবদুল আউয়ালের ছোট্ট মেয়ে রহিমা আক্তার (৯)। নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলায় থাকত ওরা। গত ৫ জানুয়ারি রাতে রহিমা পাশের বাড়ি টিভি দেখতে গিয়েছিল। দুর্বৃত্তরা ধর্ষণের পর গলা টিপে মেরে ফেলে শিশুটিকে।

এভাবে হত্যার শিকার বা মধ্যবিত্ত ও বিত্তবান পরিবারের নির্যাতিত শিশুর রেকর্ড ওসিসিতে থাকে না বলে জানান পরিচালক।

নারী নির্যাতন রোধে কাজ করছে প্রতিনিধিত্বশীল এমন তিনটি সংস্থা বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি, আইন ও সালিস কেন্দ্র এবং ব্র্যাক বলছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষকেরা স্থানীয় ও প্রভাবশালী।  ফলে ধর্ষণের শিকার শিশুর পরিবার মামলা-মোকদ্দমায় জড়াতে চায় না। ধর্ষকের বিচারও হয় না।

শিশুরা কতটা নাজুক

এ বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত পত্রপত্রিকায় ধর্ষণের ৩১টি ঘটনা ছাপা হয়েছে। এর ১৭টির শিকার হয়েছে শিশুরা। শিশুরা বিদ্যালয়ে, গৃহশিক্ষকের বাসায়, নিজ বাড়িতে, প্রতিবেশীর বাড়িতে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ধর্ষণকারীরা ছিল শিক্ষক, প্রতিবেশী, আত্মীয়,
কখনো আবার সহপাঠী।

রাজধানীর দারুস সালামে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ১১ বছর বয়সী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণকারী শিশুটির খালাতো ভাই।

এর একদিন আগে ধর্ষণের শিকার হয় গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ভান্নারা এলাকার এক শিশু। ধর্ষণকারী স্থানীয় একটি স্কুলের শিক্ষক। স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে শিশুটি ও তার পরিবারকে এলাকাছাড়া করেছেন শিক্ষক। তিনি এখনো চাকরিতে বহাল আছেন।

২৩ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া প্রতিবন্ধী শিশুকে ধর্ষণ করে শিশুটির মায়ের আপন চাচা। রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় এ ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিটির বয়স ৪৫ বছর।

“নারীরা কাজের প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসছেন। সমাজ ও রাষ্ট্রের এখন কর্তব্য নারীটির বাড়িতে থাকা শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু শিশু সেই নিরাপত্তা পাচ্ছে না,” বেনারকে জানান ব্র্যাকের মানবাধিকার ও আইনগত সেবা বিভাগের পরিচালক ফস্টিনা পেরেইরা।

হয়রানির নতুন অনুষঙ্গ প্রযুক্তি

মুঠোফোনে আপত্তিকর ছবি ধারণ করে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে শিশুকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। এ কাজে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো জড়িয়ে পড়ছে শিশুরাও।

গত ৩১ মার্চ সাভারে এমন একটি ঘটনায় মামলা হয়েছে। ধর্ষণের শিকার শিশুটি শিক্ষকের বাসায় পড়তে গেলে সেখানে তারই এক সহপাঠীসহ চারজন ধর্ষণ করে ও মুঠোফোনে সেই চিত্র ধারণ করে।

মেয়েটি তার পরিবারের কাছে বিষয়টি জানালে সামাজিকভাবে আপোষরফার চেষ্টা করে পরিবারটি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মেয়েটির ওই সহপাঠীরা মুঠোফোনে ধারণ করা ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়।

এপ্রিলের শেষার্ধে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীকে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ধর্ষণ করে। ওই ঘটনায় ব্র্যাক আইনগত সহযোগিতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরে পরিবার দুটি নিজেরাই মীমাংসা করে নেয়।

“বাংলাদেশের রক্ষণশীল পরিবারকাঠামোয় যৌনতা নিয়ে আলাপ-আলোচনার সুযোগ নেই। যৌনতা জীবনের অংশ সে বিষয়টি বাবা-মা কে বুঝতে হবে। তিন–চারবছর বয়স থেকে শিশুকে যৌনশিক্ষা দিতে হবে,” বেনারকে জানান জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিক্ষক হেলালউদ্দিন আহমেদ।

তাঁর মতে, শিশুকে বলতে হবে নিজের দুপায়ের মাঝখানে, সামনে-পেছনে, মুখ ও বুকে কাউকে স্পর্শ করতে দেওয়া যাবে না, অন্যদেরও এসব অংশে স্পর্শ করা যাবে না। প্রযুক্তির উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করা অভিভাবকদেরও দায়িত্ব বলে মনে করেন তিনি।  


বিচার হয় না বেশির ভাগ ঘটনার

ওসিসি সূত্র বলছে, যারা সেখানে আসছেন তাদের বড় অংশই দরিদ্র পরিবারের। ধর্ষণের শিকার শিশুর বয়স বছর দশেকের নিচে হলে পরিবারগুলো টাকা দিয়ে মীমাংসা করে ফেলে। দশ বছরের বেশি হলে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয় সমাজ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব বিয়ে টেকেও না।

ওসিসিতে ধর্ষিতাদের আইনগত সহযোগিতা দেয় বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি।

“আইনজীবী সমিতি এখন ধর্ষণের শিকার নারী ও তার পরিবারকে দেনমোহরের অঙ্কটা যেন একটু ভারী হয় সে বিষয়ে জোরাজুরি করেন। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে যেন মেয়েটি কিছু একটা করে খেতে পারে সে জন্যই তারা এ চেষ্টা করে, জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সমিতির একজন আইনজীবী।

২০১২ সালের মার্চের শেষ সপ্তাহে আড়াই বছর বয়সী একটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। তার মা গার্মেন্টসে কাজ করেন, বাবা রিকশাচালক। ভাগ্যান্বেষণে গাইবান্ধা থেকে ঢাকায় আসার এক সপ্তাহের মধ্যে শিশুটি ধর্ষণের শিকার হয়েছিল।

ঢাকার উত্তরখানের বাসিন্দা শিশুটির বাবা বলেন, “একদিন কোর্টে গেলে সারা দিনে আর রোজগার হয় না।” পরিবারগুলোকে সে অর্থে পুনর্বাসনের তেমন কোনো সরকারি উদ্যোগ নেই।

আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ধর্ষণের ব্যাপারে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে না। কৌমার্জ হারানোর খবর জানাজানি হলে মেয়েটি স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারবে না, এসব চিন্তা থেকে অনেক সময় পরিবারগুলো এগোতে চায় না।

পুলিশের অসহযোগিতা, সরকার পক্ষের কৌঁসুলিদের অসহযোগিতা, দীর্ঘদিন ধরে বিচার চলতে থাকা এবং ধর্ষকের সাজা না হওয়ায় বিচার চান না অনেকে। অনেক সময় পুলিশ আসামি না ধরে মীমাংসা করার কাজে আগ্রহী হন বেশি এমন অভিযোগও আছে।

“বেশ কিছু থানায় এখন শিশুদের জন্য আলাদা ডেস্ক আছে। কোনো শিশু হয়রানির শিকার হলে যেন সুবিচার পায় তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করার নির্দেশ দেওয়া আছে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেছুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।