রাজন হত্যা: ১৩ জনকে আসামি করে চার্জশিট

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.08.17
BD-child রাজন হত্যার পর দেশব্যাপি প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। জুলাই, ২০১৫
বেনার নিউজ

কামরুল ইসলামকে প্রধান আসামি করে সিলেটে শিশু শেখ সামিউল আলম রাজন (১৪) হত্যা মামলায় রোববার আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেছে পুলিশ। আদালত আগামি ২৪ আগষ্ট শুনানি শুরুর দিন ধার্য করেছে।

এতে অভিযুক্ত করা হয়েছে ১৩ জনকে। ঘটনার মূল হোতা কামরুলকে অভিযোগপত্রে পলাতক দেখানো হয়েছে। আর বিতর্কিত সেই পুলিশ কর্মকর্তা (এসআই) আমিনুল ইসলামকেই রাখা হয়েছে বাদী হিসেবে। যিনিই শিশু রাজনকে এজাহারে ‘অজ্ঞাত যুবক’ এবং  ‘চোর’  দেখিয়ে প্রথম মামলা ফাইলবন্দি করেন।


যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ

অভিযোগপত্রে অভিযুক্ত ১৩ জন হচ্ছেন—পালিয়ে সৌদি আরব গিয়ে আটক হওয়া কামরুল ইসলাম,  তাঁর বড় ভাই মুহিত আলম, আরেক ভাই আলী হায়দার ওরফে আলী, শামীম আহমদ, চৌকিদার ময়না মিয়া ওরফে বড় ময়না, রুহুল আমিন, শামীম আহমদ, পাবেল ওরফে রাজু মিয়া, দুলাল আহমদ, তাজউদ্দিন আহমদ ওরফে বাদল, আয়াজ আলী, আজমত উল্লাহ ও নির্যাতনের ভিডিও চিত্র ধারণকারী নূর আহমদ ওরফে নূর মিয়া।

কামরুল ছাড়াও শামীম ও পাবেল ওরফে রাজুকে অভিযোগপত্রে পলাতক দেখানো হয়েছে।

তবে এই অভিযোগপত্রে সন্তুষ্ট নন বলে জানান সামিউলের বাবা শেখ মো. আজিজুর রহমান। বেনারকে তিনি বলেন, বিদেশে কামরুল আটক হলেও তাকে ফিরিয়ে আনার কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছেনা। এছাড়াও ঘটনা ধামাচাপা দেয়া ও মূল আসামি কামরুলকে সৌদি আরবে পালিয়ে যাওয়ার সহযোগিতা করা পুলিশদের নাম অভিযোগপত্রে আসে নি। আর কারও নাম বাদ পড়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, অভিযোগপত্রটি দেখতে পেলে বলতে পারবেন তিনি।


মামলার কাজ দ্রুত এগিয়ে


ঘটনার এক মাস আট দিনের মাথায় রোববার সন্ধ্যায় সিলেট মহানগর হাকিম আদালতে (এমএম-১) অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। সোমবার (১৭ আগস্ট)এই চার্জশীটের পর্যালোচনা ও শুনানির দিন ২৪ আগস্ট ধার্য করেন মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ২য় আদালতের বিচারক ফারহানা ইয়াসমিন। অত্র আদালতের জেনারেল রেজিস্টার (জিআর)-এর দায়িত্বে থাকা পুলিশের এএসআই ফরিদ আহমদ এ তথ্য নিশ্চিত করেন।


তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়,  সামিউলকে চুরির মিথ্যা অপবাদে নির্যাতন করা হয় এবং নির্যাতনের কারণেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। এর সঙ্গে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলা হয়,  সামিউলের শরীরে নির্যাতনের ৬৪টি চিহ্ন পাওয়া গেছে। ঘটনার প্রধান আলামত হিসেবে নির্যাতনের ভিডিও চিত্রের একটি কপি অভিযোগপত্রের সঙ্গে দাখিল করা হয়েছে।


মামলার বাদী ও স্বাক্ষী

এদিকে, খুনের ঘটনার পরদিন (৯ জুলাই) রাজনের বাবা বাদী হয়ে থানায় একটি এজাহার দাখিল করলেও শেষ পর্যন্ত চার্জশীটে তাকে বাদী না দেখিয়ে ২নং স্বাক্ষী হিসেবে রাখা হয়েছে।

অবশ্য এর ব্যাখা দিয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সুরঞ্জিত তালুকদার বেনারকে বলেন,  আইনানুযায়ী প্রথম মামলা দায়েরকারী-ই চার্জশীটে বাদী ও প্রধান সাক্ষী। সে হিসেবে এসআই আমিনুলকে মামলার বাদী রাখা হয়েছে। তিনি আদালতে মামলার ঘটনার বর্ণনা দেবেন।

রাজনের বাবা ছাড়াও মামলায় তৃতীয় ও চতুর্থ স্বাক্ষী রাজনের মা লুবনা বেগম, চাচা আল আমিন। স্বাক্ষীর তালিকায় আছেন মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা(বরখাস্তকৃত) জালালাবাদ থানার সাবেক ওসি (তদন্ত) আলমগীর হোসেন।

এছাড়া চার পৃষ্ঠার চার্জশীটে ৩৮ জন স্বাক্ষীর ২৯ জনই স্থানীয় জনতা। সুরঞ্জিত তালুকদার জানান, অভিযুক্ত ১৩ জনের মধ্যে ১০ জন গ্রেপ্তার আছেন, বাকি তিনজন পলাতক। সাক্ষী রাখা হয়েছে ৩৮ জনকে। একজন আসামির স্ত্রীসহ দুজনকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে। এরা হলেন, বর্তমানে কারাবন্দি আসামি মুহিতের স্ত্রী লিপি বেগম এবং তাঁর ভাই ইসমাইল হোসেন ওরফে আবলুছ। এদের ‘নির্যাতনে জড়িত থাকার প্রমাণ মেলেনি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

আসামিদের মধ্যে মুহিত, আলী হায়দার, চৌকিদার ময়না, নূর আহমদসহ প্রত্যক্ষদর্শী আটজন ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

এদিকে, মামলার সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনকারী সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. রহমত উল্লাহ বলেন, পলাতক কামরুলকে সৌদি আরব থেকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। তাঁকে ফিরিয়ে আনতে ‘রেড অ্যালার্ট’  জারি রয়েছে।


যারা ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল তাদের কি হবে?

এ বিষয়ে বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বেনারকে বলেন,  শিশু রাজন হত্যার ঘটনা নিকৃষ্টতম অপরাধ। পুলিশের আন্তরিক প্রচেষ্টায় দ্রুততম সময়ে যে অভিযোগপত্র দেয়া গেছে তা উৎসাহব্যঞ্জক। তবে হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দেয়া ও অভিযুক্তদের পালিয়ে যেতে যেসব পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সহায়তার অভিযোগ উঠেছে তাও গুরুত্ব সহাকারে দেখা উচিৎ। কারণ, অপরাধীদের সহায়তা করা ফৌজদারি অপরাধ। তিনি বলেন,  রাজন হত্যার ঘটনার সুষ্ঠু বিচার সম্পন্ন হলে অপরাধীদের কাছে তা কঠিন বার্তা পৌছাবে।

গত ৮ জুলাই চুরির মিথ্যা অভিযোগ তুলে নির্যাতন করে হত্যা করা হয় সিলেটের জালালাবাদ থানা এলাকার বাদেয়ালি গ্রামের মাইক্রোবাস চালক শেখ মো. আজিজুর রহমানের ছেলে সবজি বিক্রেতা শিশু সামিউলকে। নির্যাতনের ঘটনাটি ঘটে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডের কাছে শেখপাড়ায়। পরে লাশ গুম করার চেষ্টার সময় একজন ধরা পড়ে। এরপরও ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়।


নিজেদের তোলা ভিডিও-তেই ফেঁসে গেলো সবাই

সামিউলকে নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করেছিলেন নির্যাতনকারীরাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিওচিত্রটি ছড়িয়ে পড়লে তোলপাড় শুরু হয়। দেশে-বিদেশে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। একে একে জনতা ধরিয়ে দেয় সামিউল হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের। পালিয়ে সৌদি আরব গিয়ে প্রবাসীদের হাতে ধরা পড়েন ঘটনার মূল হোতা কামরুল ইসলাম।

আসামি কামরুলের দেশ ছেড়ে পালানোয় ঘটনার শুরুর দিকে গাফিলতির অভিযোগে গত ২৭ জুলাই সিলেট মহানগর পুলিশের জালালাবাদ থানার তৎকালীন ওসি-তদন্ত(পরিদর্শক) আলমগীর হোসেন, উপরিদর্শক (এসআই) আমিনুল ইসলাম (রাজনের প্রথম বাদী) ও মো. জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

এরপর মামলাটি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দেন কমিশনার কামরুল আহসান। ওখানে মামলাটির দায়িত্ব পান গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক সুরঞ্জিত তালুকদার। যিনি রোববার এ মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশীট) আদালতে দাখিল করেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।