বড়দিনে খুশির মাঝেও শঙ্কা, বাড়তি নিরাপত্তা চার্চে

শাহরিয়ার শরীফ ও কামরান রেজা চৌধুরী
2015.12.24
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
BD-christmas বডদিন উপলক্ষে বিভিন্ন চার্চে ও পাঁচতারা হোটেলে ঢাকায় বর্নিল সাজসজ্জার আয়োজন করা হয়েছে।
বেনার নিউজ

খ্রিষ্টানদের সবচেয়ে বড় ও প্রধান ধর্মীয় উৎসবের দিন ২৫ ডিসেম্বর শুক্রবার, সেদিন সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়াও ঈদ-ই মিলাদুন্নবী  উপলক্ষে সরকারি ছুটি। একদিনে তিনটি ছুটি হওয়ার নজির নিকট অতীতে নেই।

আজ থেকে দুই হাজারেরও বেশি বছর আগে এদিনে জেরুজালেমের কাছে বেথলেহেমে মা মেরির গর্ভে জন্ম নেন যিশুখ্রিস্ট।

বড়দিন যিশুখ্রিষ্টের প্রেম ও মানবিকতার বাণীতে প্রভাবিত হয়ে সব মানুষকে আপন করার দিন। আনন্দ-উৎসবের পাশাপাশি তাঁর শান্তির বাণী ছড়িয়ে দেওয়া বড়দিনের শিক্ষা।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদা আর আনন্দঘন পরিবেশে দিনটি উদ্‌যাপন করা হচ্ছে । বড়দিনে বিভিন্ন গির্জা ও খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করার কথা জানিয়েছে সরকার।

বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার শতকরা এক ভাগ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী৷ ঢাকাসহ সারাদেশে প্রায় ৫০০টি গির্জায় এবার বড়দিন উদযাপিত হচ্ছে৷ এই উত্‍সবের নিরাপত্তা নিয়ে সন্তুষ্ট বাংলাদেশের খ্রিষ্টধর্মের অনুসারীরা৷

‘‘সারাদেশে গির্জায় গির্জায় এরইমধ্যে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে৷ পুলিশ এবং প্রশাসনের লোকজন ঢাকাসহ গোটা বাংলাদেশের গির্জা পরিদর্শন করেছেন৷ আমরা নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট৷ তবে শঙ্কা মুক্ত নই,'' বেনারকে জানান খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নির্মল রোজারিও।

দেশের ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্টদের সব গির্জা রঙিন বাতি আর ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে মনোরমভাবে। সেগুলোতে সুন্দরভাবে বসানো হয়েছে ক্রিসমাস ট্রি। ঢাকার পাঁচতারকা হোটেলগুলো সেজেছে আরও বর্ণময় সাজে।

ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে হচ্ছে আনন্দঘন আয়োজন। খ্রিষ্টানদের ঘরে ঘরেও আছে উৎসবের আয়োজন। ওই দিন সকালে সব বয়সের খ্রিষ্টান গির্জায় বিশেষ প্রার্থনায় অংশ নেবেন।

খাবার দাবারের আয়োজনও দেশীয় রীতিতে৷ পিঠা, পুলি পায়েস – এ সব তো খাবারের তালিকায় থাকছেই৷ আর আছে বড়দিনের মেলা৷


খ্রিষ্টান সম্প্রদায় সন্ত্রাসী হামলার আতঙ্কে

খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ বড়দিন পালনকালে হামলার আশংকায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ ক্রিশ্চিয়ান এসোসিয়েশনের সাধারন সম্পাদক বেনারকে জানান, “আমরা আতংকের মধ্যে বড়দিন পালন করতে যাচ্ছি। বাংলাদেশে এর আগে কখনো বিশ্বাসের জন্য কাউকে টার্গেট করা হয় নাই”।

তিনি জানান, গত সেপ্টেম্বরে ধর্মজাজক ও প্রিস্টদের উপর হামলার পর অন্তত ২৪ টি ক্ষেত্রে মৃত্যুর হুমকি দেয়া হয়েছে।

নওগাঁ জেলার প্রোট্যাস্টেন্ট জাজক আলবার্ট ফিলো জানান, “ হামলার আশংকায় আমরা অব্যাহতভাবে ভীত”। মাত্র দু’সপ্তাহ আগে তার বাসার কাছেই চার্চের একটি ঘরে অচেনা লোকজন এসে আগুন দেয়।

“আমরা এবছরের মতো কখনো এরকম অবস্থার মধ্যে পড়িনি।এটা আমাদের জন্য এক দুঃসহনীয় বছর”।

গত দুইমাসে প্রায় ৫ দফা কিছু লোক চার্চে এসে প্রশ্ন করে গেছে আমরা কেনো লোকজনদের ধর্মান্তর করছি, বলেন তিনি।

গত শুক্রবার খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ সরকারের কাছে চার্চে লোকজনদের সুরক্ষায় নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োজিত করার আবেদন জানান। ১৬ কোটি ৮৯ লক্ষ জনসংখ্যার এই দেশে সংখ্যালঘু খ্রিষ্টানদের সংখ্যা মাত্র ৫ লাখের মত।

ঢাকার হোলি রোজারি চার্চের ক্যাথলিক প্রিস্ট ফাদার আলবার্ট টি রোজারিও বেনারকে বলেন, “ক্রিস্টমাসের প্রার্থনাকালে আমরা হামলার ভয়ের মধ্যে আছি, কারণ আমরা গোটা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন নই। আমরা এ বছরের মতো আগে কখনো বড়দিনগুলোতে ভীত ছিলাম না”

২০১৫ সাল জুড়ে প্রকাশক সহ ব্লগার হত্যা, বিদেশি হত্যা, শিয়া ও হিন্দুদের উপর হামলার ঘটনা একের পর এক ঘটে গেছে। যা সকল সম্প্রদায়ের লোকজনদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।


অস্ট্রেলিয়া তাদের নাগরিকদের সতর্ক করেছে

বড়দিন ও ইংরেজি নববর্ষ সামনে রেখে পশ্চিমা স্বার্থে বাংলাদেশে জনসমাগমের স্থানগুলোতে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকদের সতর্ক থাকতে বলেছে সে দেশের সরকার।

বাংলাদেশে অবস্থানের সময় আগের মতোই সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকদের। গত মঙ্গলবার অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হালনাগাদ ভ্রমণ বার্তায় এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার বার্তায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার উচ্চমাত্রার ঝুঁকি আছে। অতীতে বাংলাদেশে বেশ কিছু সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা জঙ্গি ও সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত লোকজনকে গ্রেপ্তার করে চলেছেন। এসব সংগঠনের মধ্যে কারও কারও পশ্চিমাবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি আছে।

বড়দিন ও নতুন বছরকে উদ্‌যাপনে জনসমাগমের স্থানগুলোতে চলাফেরার সময় অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকের সতর্ক থাকা উচিত। পশ্চিমা স্বার্থে পুনরায় হামলার সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশে চলাফেরার সময় সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।


সরকারের নিরাপত্তার আশ্বাস, বিদেশিদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তা

গত মঙ্গলবার  ঢাকার আর্চবিশপ প্যাট্রিক ডি’রোজারিয়র নেতৃত্বে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের একটি দল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে নিরাপত্তার ব্যপারে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বিশপ পরে বেনারকে জানান, “তিনি আমাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছেন এবং বাংলাদেশে খ্রিষ্টানদের অবদানের কথা স্মরণ করেন”।

খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব বড়দিন আর গ্রেগরিয়ান বর্ষবরণ 'থার্টিফার্স্ট নাইট'কে কেন্দ্র করে এবার গোয়েন্দা নিরাপত্তার পাশাপাশি রাস্তায় টহলসহ 'দৃশ্যমান' নিরাপত্তা বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।

তিনি জানিয়েছেন, বড়দিনে বিভিন্ন গির্জা ও খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকা এবং ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার কূটনৈতিক পাড়াসহ বিশেষ কয়েকটি এলাকা ‘বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থার আওতায়’ আনা হবে; বিদেশি নাগরিকদের জন্যও থাকবে বাড়তি নিরাপত্তা।

বড়দিন ও ‘থার্টিফার্স্ট নাইট’ উদযাপন উপলক্ষে গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা কমিটির এক সভা শেষে মন্ত্রী সাংবাদিকদের এ কথা জানান।

তিনি বলেন, খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নির্মল রোজারিও বড়দিনে গির্জাগুলোতে গতবছরের চেয়ে বাড়তি ও দৃশ্যমান নিরাপত্তা চেয়েছেন।

"তারা যেন উৎসবমুখরভাবে বড়দিন পালন করতে পারেন, সেজন্য গোয়েন্দা নজরদারি ছাড়াও আমরা দৃশ্যমান নিরাপত্তা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"

দৃশ্যমান নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট এলাকায় বিভিন্ন সরঞ্জাম ব্যবহার করে ব্যক্তি বা সম্পদের ধ্বংস ও ক্ষতির ঝুকি এড়ানোর পাশাপাশি অনিয়ন্ত্রিত প্রবেশ ঠেকানোর লক্ষ্যে লোকবল নিয়োগ ও নজরদারি চালানো হয়।

এ ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরায় (সিসিটিভি) নজরদারির পাশাপাশি নিরাপত্তাপ্রহরা, সুরক্ষামূলক বাধা তৈরি, মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে তল্লাশিসহ কয়েক স্তরের আয়োজন থাকে।

বড়দিনে রাজধানীর ৬০টি গির্জাসহ সারা দেশের সব গির্জা ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার (সিসিটিভি) আওতায় আনার পাশাপাশি আর্চওয়ে ও মেটাল ডিটেক্টর থাকবে বলে জানান তিনি।


ঈদ-ই মিলাদুন্নবী

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্ম ও মৃত্যুর দিনটি বিশ্বের মুসলমানরা ঈদ-ই মিলাদুন্নবী হিসেবে পালন করেন। মহানবী ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহণ করেন। ৬৩ বছর বয়সে ৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দের একই তারিখে মারা যান তিনি।

এ উপলক্ষে ইসলামিক  ফাউন্ডেশন বিস্তারিত কমর্সূচী গ্রহণ করেছে ।  বিভিন্ন মসজিদে ইবাদত, দোয়া ও মিলাদ অনুষ্ঠিত হবে।  

এবার ২৫ ডিসেম্বর খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বড়দিনেই ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ঈদ-ই-মিলাদুন্নাবী হচ্ছে।

দুই ধর্মের অনুষ্ঠান একই দিনে হওয়ায় 'কোনো ধরনের সমস্যা হবে না' মন্তব্য করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, "বাঙালিরা ধর্মভীরু, কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। তাই কোনো সমস্যা হবে না।"

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।