ঢাকার সমস্যা সমাধানের অঙ্গীকার ছয় মেয়র প্রার্থীর, নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হচ্ছে

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.04.21
BD-citypoll ঢাকার সিটি নির্বাচনে ৬ মেয়র প্রার্থী। সবাই প্রতিশ্রুতি দিলেন নির্বাচিত হলে সব সমস্যার করবেন। ২০ এপ্রিল,২০১৫
বেনার নিউজ

ঢাকা শহরের প্রায় সব সমস্যাই এখন চিহ্নিত। দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে সমন্বিতভাবে এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। নগর ভবনকে সত্যিকার নাগরিক সেবার কেন্দ্রে পরিণত করাই নির্বাচিত মেয়রের কাজ।

একসঙ্গে বসে এমন মত দিয়েছেন ঢাকার ছয় মেয়র প্রার্থী। একজন বাদ দিলে পাঁচজনই বয়সে তরুণ বলে বিবেচিত। বাকি একজন প্রার্থী আনিসুল হক ষাটের কাছাকাছি বয়সে পৌঁছলেও নিজেকে তরুণ প্রমান করতে সমর্থকদের নিয়ে দুই কিলোমিটার দৌড়েছেন, সাইকেলে ঘুরে প্রচার করছেন।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের এসব প্রার্থীকে নিয়ে ২০ এপ্রিল ‘আমি যদি মেয়র হই’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করেছিল দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক প্রথম আলো। এসব প্রার্থী আগে কখনও সিটি করপোরেশন নির্বাচন করেননি। রাজনীতির মাঠেও তাঁরা ততটা পরিচিত নন।

প্রায় ১৩ বছর পর আগামী ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য এই নির্বাচন উপলক্ষে ঝিমিয়ে পড়া নাগরিক সেবা চাঙ্গা হওয়ার সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে মেয়র প্রার্থীদের অঙ্গীকার ও ইশতেহারে। আইনি জটিলতার অজুহাতে নির্বাচনের পরিবর্তে সরকার প্রশাসক দিয়ে এতদিন চালিয়েছে দুই সিটি করপোরেশন।

এই দুটি সিটি করপোরেশনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আসার আগেভাগে রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে শহরজুড়ে। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তাঁর দলের প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচার চালাতে গিয়ে তিনদফা অবরোধের মুখে পড়েছেন, ১৯ এপ্রিল তাঁর গাড়ির বহরে হামলা হয়েছে।

এরই মধ্যে মঙ্গলবার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামী ২৬ থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত চার দিন তিন সিটি করপোরেশন এলাকায় সেনা মোতায়েন থাকবে।

বিরোধী দল বিএনপি মূলত সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়ে আসছিল। সরকারি দল এর প্রয়োজন নেই বললেও শেষমেষ সেনা মোতায়েন করেছে নির্বাচন কমিশন।
“সুষ্ঠু ও ভালো নির্বাচনের স্বার্থে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ভোটকেন্দ্রের বাইরে ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে স্ট্র্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনা মোতায়েন থাকবে,” মঙ্গলবার এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের জানান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ।

সেনা নিয়োগ নিয়ে পক্ষে–বিপক্ষে রাজনৈতিক দলের ভিন্নমত থাকলেও প্রার্থীরা এখন ভোটারদের বাড়ি বাড়ি ঘুরতে এবং সভা–সমাবেশ করতে ব্যস্ত। এরই মধ্যে প্রথম আলো তাঁদের একত্রে ডেকে নগরবাসীর জন্য ভবিষ্যত করণীয় শোনার উদ্যোগ নেয়।

ওই বৈঠকে মেয়র প্রার্থীরা বলেন, দীর্ঘ সময় জনপ্রতিনিধি না থাকায় নগরবাসী ক্ষুব্ধ ও বঞ্চিত। তাই এখন শুধু গতানুগতিক কাজকর্মে সীমাবদ্ধ থাকলে তারা খুশি হবে না। নির্বাচিত হয়ে প্রত্যেকেই নগরবাসীকে সঙ্গে নিয়ে এবং তাঁদের সম্পৃক্ত করে নাগরিক সেবায় আমূল পরিবর্তন আনার অঙ্গীকার করেন তাঁরা।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই গোলটেবিল বৈঠকে দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের প্রতিনিধি এবং তিনজন নগরবিশেষজ্ঞ উপস্থিত ছিলেন।

এঁদের একজন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, “আমি আনন্দিত ও আশান্বিত। আমি ভাবছি, এত দিন এসব তরুণ কোথায় ছিলেন। ওনারা নিশ্চয়ই ঢাকাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।”

“এঁদের মধ্যে যিনি নির্বাচিত হবেন, তিনি ঢাকাকে এগিয়ে নিতে পারবেন, এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস,” জানান নগর বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল।

নগরের সমস্যা সমাধানে অংশগ্রহণমূলকভাবে কাজ করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আনিসুল হক। নির্বাচিত হলে এলাকাভিত্তিক অংশগ্রহণমূলক কমিটি গঠন এবং সেই সঙ্গে প্রয়োজন হলে নগর সরকার গঠনের চেষ্টা করার কথা জানান তিনি।

“ইশতেহার তৈরির আগে ঢাকার ৫২টি সমস্যা নিয়ে একটি জরিপ করেছি। এর মধ্যে ৬৮ শতাংশের মতে, নগরের সবচেয়ে বড় সমস্যা মশা। অতএব, সমস্যা চিহ্নিত, এখন মেয়রের কাজ মশক নিধন করা,” জানালেন আনিসুল হক, যিনি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি ছিলেন।

তাঁর মতে, ঢাকার প্রত্যেক নাগরিকই জানে এই শহরের সমস্যার কথা। প্রতি দশজন নাগরিককে জিজ্ঞাসা করলে আটটি সমস্যা কমন পড়বে।

সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক জরীপে বিশ্বের ১৪২টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান হয়েছে ১৪১তম। এ নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও ট্র্যাফক জ্যাম, ফুটপাত দখল, অপরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তাহীনতা এবং ভেজাল খাদ্যের ফলে এই শহর যে দিনদিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে, তা নিয়ে খুব একটা বিতর্ক নেই।

দেশী–বিদেশী বিভিন্ন জরিপ ও গবেষণায় ঢাকা সম্পর্কে নেতিবাচক তথ্য প্রকাশ হওয়া সম্পর্কে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী সাঈদ খোকন বলেন, “ঢাকা একটি আবেগময় ও স্মৃতিময় বন্ধনে জড়ানো শহর। এই বন্ধনের মধ্যেই রয়েছে সংকট সমাধানের সম্ভাবনা।”  

দলমত-নির্বিশেষে নগরবাসীকে সম্পৃক্ত করে নতুন ঢাকা উপহার দেওয়ার অঙ্গীকার করে সাঈদ খোকন বলেন, তাঁর বাবা ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ‘নগর সরকার’-এর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। নির্বাচিত হলে তিনিও ‘নগর সরকার’ গঠনের উদ্যোগ নেবেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী সাঈদ খোকন বলেন, মেয়র নির্বাচিত হলে প্রথমেই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে একটি সংলাপ করবেন। নাম হবে ‘ঢাকা ডায়ালগ’। এর ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন তিনি।

উত্তর সিটিতে বিএনপি-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী তাবিথ আউয়াল বলেন, “ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে আছে, এটা আমরা জানি। আমরা সেবা পাচ্ছি না। দিন দিন সেবার মান নিচের দিকে যাচ্ছে।”

ঢাকা নিয়ে ১৫ বছর ধরে গবেষণার দাবি করে তাবিথ বলেন, “সমস্যাগুলো চিহ্নিত। এখন সমাধান করতে হবে। গতানুগতিক চিন্তায় সেটা হবে না।” তাবিথ দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ি আবদুল আউয়াল মিন্টুর পুত্র। মিন্টুর মনোনয়ন বাতিল হওয়ায় তাবিথ প্রার্থী হয়েছেন।

অপরিকল্পিতভাবে ঢাকা শহর গড়ে ওঠার কথা উল্লেখ করে তাবিথ বলেন, নির্বাচিত হলে সমন্বিতভাবে কাজ করবেন। তাঁর স্বপ্ন নারী ও শিশুবান্ধব ঢাকা গড়ে তোলা।

উত্তর সিটি করপোরেশনে বিকল্পধারা বাংলাদেশ-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী মাহী বি. চৌধুরী বলেন, “ঢাকার সমস্যা চিহ্নিত হওয়ার বিষয়ে সবাই ঐকমত্যে পৌঁছেছি। এখন কী করব, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কীভাবে করব।’ তিনি বলেন, ‘আমরা নিরাপদ ঢাকা চাই, চলমান ঢাকা চাই, আলোকিত ঢাকা চাই।”

নির্বাচিত হলে সমস্যা সমাধানে নবীন-প্রবীণ মিলে ‘স্বচ্ছতা কমিটি’ এবং প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ‘বিশেষ উপদেষ্টা কাউন্সিল’ গঠন করার ঘোষণা দেন মাহী।এ ছাড়া দায়িত্ব পেলে ঢাকাকে প্রজন্মের শহরে পরিণত করার আগ্রহ প্রকাশ করেন।

সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ছেলে মাহী বি চৌধুরী। বিএনপি সরকারের সময়ে প্রধানমন্ত্রী কালেদা জিয়ার সঙ্গে বিরোধের জের ধরে পদত্রাগ করেন বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং বিকল্প ধারা নামে একটি নতুন দল গঠন করেন।

নির্বাচিত হলে সবার জন্য বাসযোগ্য মানবিক ঢাকা গড়ে তোলার কথা বলেন একই সিটিতে সিপিবি-বাসদ-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী আবদুল্লাহ আল ক্বাফী। ৭১ দফা নির্বাচনী অঙ্গীকার তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমরা তারুণ্যের পুনর্জাগরণ চাই। এ জন্য ৭১ দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েছি।’

পেশায় ব্যাংকার এই প্রার্থী মেয়র নির্বাচিত হলে ন্যায়পাল নিয়োগ ও দুর্নীতিমুক্ত নগর প্রশাসন গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেন। এই প্রার্থী নিজেও দুর্নীতি থেকে দূরে থাকতে আট দফা ব্যক্তিগত অঙ্গীকারনামা তুলে ধরেন।

নগরের বিভিন্ন সমস্যার কথা উল্লেখ করে একই সিটিতে মেয়র পদপ্রার্থী জোনায়েদ আবদুর রহিম সাকি (জোনায়েদ সাকি) বলেন, “নগর সরকার’ ছাড়া সমস্যার প্রকৃত সমাধান সম্ভব না। নির্বাচিত হলে নাগরিকদের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন তিনি। তাঁর মতে, মানুষ পরিবর্তন চায়, এই নির্বাচনের মাধ্যমেই সেই পরিবর্তন হবে।

বৈঠকে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ সম্ভাব্য মেয়রদের কাউন্সিলরদের সমন্বয়ে কাজ করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, “মেয়র একনায়কের মতো সিটি করপোরেশন চালাতে পারেন না। তাঁকে অংশগ্রহণমূলকভাবে কাউন্সিলরদের নিয়ে নগর প্রশাসন চালাতে হবে।”

একঝাঁক তরুণের মেয়র পদপ্রার্থী হওয়ার ঘটনাকে ইতিবাচক অভিহিত করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সারওয়ার জাহান বলেন, “নগরভবনে  সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সুশাসন। এ জন্য দরকার স্বচ্ছভাবে কাজ করা, জবাবদিহি নিশ্চিত করা।”

“নির্বাচিত হওয়ার পর মেয়রদের ভালো কাজে সমর্থন দেওয়া হবে। একই সঙ্গে ভুল কাজের সমালোচনা করা হবে,” প্রার্থীদের সামনে পত্রিকার এই অবস্থানের কথা তুলে ধরেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান।


মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।