কাজই শুরু করতে পারেননি ঢাকার নারী কাউন্সিলররা
2015.06.05
“নির্বাচিত হওয়ার পর এক মাস পেরিয়ে গেছে। সিটি করপোরেশন থেকে দায়িত্ব বুঝে পাইনি। কাজও শুরু করতে পারিনি,” বেনারকে জানান নার্গিস।
নার্গিস মাহতাব সংরক্ষিত ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত নারী কাউন্সিলর। নির্বাচনী প্রচারের সময় এলাকাবাসীকে স্বস্তিতে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ভাঙা রাস্তাঘাট মেরামত করবেন বলেছিলেন, করেছিলেন মাদকমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গিকারও।
নার্গিস আহমেদ ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের একজন।
সিটি করপোরেশনে প্রতি তিনটি ওয়ার্ড থেকে একজন নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ১২ জন এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১৯ জন নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন।
সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের অনেকেই এখন পর্যন্ত কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। অতীতে যাঁরা এ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁদের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাঁরা অল্প কিছু কাজের দায়িত্ব পেয়েছিলেন।
নবনির্বাচিতদেরও একই হাল হয় কি না সে নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছেন কেউ কেউ। কমপক্ষে ছয়জন কাউন্সিলর বেনারকে বলেছেন, তাঁরা নিজ নিজ মেয়রের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা চান মেয়র তাঁদের কাজে লাগাক। তবে এখন পর্যন্ত মেয়রদের কাছ থেকে খুব একটা আশাব্যঞ্জক সাড়া তাঁরা পাননি।
তবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বেনারকে বলেছেন, তাঁরা নগর পরিচালনার কাজে নারী-পুরুষে কোনো বৈষম্য করছেন না। কিছু কিছু কাজে ইতিমধ্যেই সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাধারণ ওয়ার্ড ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের কাজের সমান সুযোগ নিশ্চিত করার একটি নির্দেশ আছে উচ্চ আদালতের। তবে এ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের যেমন অজ্ঞতা আছে, তেমনি নারী কাউন্সিলরদেরও খুব পরিষ্কার ধারণা নেই।
সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের কেউ কেউ ধরেই নিয়েছেন, সরাসরি নির্বাচিত ওয়ার্ড কাউন্সিলররা, বেশিরভাগক্ষেত্রে পুরুষ কাউন্সিলররাই কাজ বেশি পাবেন। তবে তাঁরাও কিছু কিছু কাজ পাবেন। কেউ কেউ আবার পুরুষ কাউন্সিলরদের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে পারলেই যেন খুশি।
২০০৪ সালের ১৬ আগস্ট হাইকোর্ট যে আদেশে কাউন্সিলরদের কাজে বৈষম্য করা যাবে না বলে আদেশ দিয়েছিলেন, সেই আদেশের ব্যাখ্যায় আদালত আরও বলেছিলেন, “কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যখন সংরক্ষিত কোটায় ছাত্র ভর্তি করা হয় তখন তাকে আলাদা কোনো সনদ দেওয়া হয় না। ভর্তির পর সাধারণ ও কোটার মাধ্যমে ভর্তি হওয়া ছাত্রদের সমান চোখে দেখা হয়। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর কমিশনারদের মধ্যেও কোনো বিভাজন থাকবে না।”
“স্থানীয় সরকার আইন ২০০৯ এ কোনো কাউন্সিলরের মধ্যে বৈষম্য থাকবে না এ কথা পরিষ্কারভাবে বলা আছে। আমি বলব সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের উচিত হবে আইনটা পড়ে নিজেদের দায়িত্ব কি সেটা বুঝে নিয়ে আদায়ের চেষ্টা শুরু করা। কারও মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে আসলে চলবে না,” বেনারকে জানান নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী।
আদালতের নির্দেশ থাকলেও সংরক্ষিত কাউন্সিলরদের প্রায় সবাই দায়িত্ব বা কার্যালয় পাননি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এলাকাভুক্ত মিরপুরের তিনটি ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত সংরক্ষিত কাউন্সিলর রাশিদা আক্তার ঝর্ণা। গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত সে অর্থে কোনো দায়িত্ব খুঁজে পাননি।
নির্বাচনী দৌড়ে নামার আগে তিনটি ওয়ার্ডের খুঁটিনাটি সব নাগরিক সমস্যা চিহ্নিত করেছিলেন ঝর্ণা। সে অনুযায়ী সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। নির্বাচিত হওয়ার পর ঠিক কোথা থেকে কীভাবে শুরু করবেন বুঝতে পারছেন না।
“প্রতিবেশী হাজি রজব হোসেন সরাসরি আসনে বিজয়ী হয়েছেন। চেষ্টা করছি তাঁর সঙ্গে জোট বেঁধে কাজ করতে,” জানান ঝর্ণা।
ঝর্ণা আরও বলেন, ‘মেয়র আনিসুল হকের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি আশ্বস্ত করেছেন কাজ দেবেন। আমি এখন এলাকার সমস্যার কথা রজব ভাইকে (হাজি রজব হোসেন) বলি। উনি ব্যবস্থা নেন।”
কাজের দায়িত্বের পাশাপাশি সুযোগসুবিধা প্রাপ্তির দিক থেকেও পিছিয়ে আছেন নারী কাউন্সিলররা। উত্তরের নারী কাউন্সিলর শাহনাজ পারভীন বেনারকে বলেন, “আমরা এখনো অফিস পাইনি। পুরুষ কাউন্সিলররা শপথ নেওয়ার পরপরই সচিব পেয়ে গেছেন। আমরা পাইনি। আমাদের কাছ থেকে অবশ্য কয়েক দিন আগে কী কী প্রয়োজন জানতে চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।”
অফিস এবং সচিব পেলে এলাকাবাসী তাঁদের সঙ্গে প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন। সেটা এখন করতে পারছে না বলে জানান শাহনাজ।
শাহনাজ বলছিলেন, তিনি রাজনীতি করছেন একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে। এ বছর নারী কাউন্সিলর হয়েছেন। তাঁর ইচ্ছে নির্বাচন করে সাংসদ হওয়ার। কাজ করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে না পারলে এমপি হিসেবে মনোনয়ন পাওয়া বা জেতা কঠিন হবে। তাই তিনি যেভাবেই হোক কাজ করতে চান।
জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক বলেছেন, “এখনো কাজ ভাগ করা হয়নি। কাউন্সিলরদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত আছে। একই রাস্তার উন্নয়ন করতে চাইছেন সরাসরি নির্বাচিত কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর। কীভাবে দু’পক্ষ মিলেমিশে কাজ করতে পারে তা-ই ভাবছি।”
সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বা কাজ ভাগ করে দিতে কত দিন লাগতে পারে, তা জানতে চাইলে আনিসুল হক বলেন, তিনি চেষ্টা করছেন। কাউন্সিলরদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছেন। শিগগিরই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে।
দক্ষিণের কাউন্সিলর ফাতেমা আক্তার ডলিও বেনারকে জানান, “আমরা জানতে পেরেছি জুন-জুলাইয়ে সিটি করপোরেশনের বাজেটের কাজটা শেষ হলেই দায়িত্ব বুঝে পাব।”
বাজেট প্রণয়নের কাজে কেন সম্পৃক্ত করা হয়নি সে সম্পর্কে অবশ্য তিনি কিছুই জানেন না।
একই অবস্থা নার্গিস মাহতাবের। এখন পর্যন্ত কাজ বলতে, তাঁর এলাকায় সন্ধ্যাবেলায় রাস্তায় বাতি জ্বলত না। সিটি করপোরেশনে জানানোর পর এলাকায় কয়েকটা বাতি লেগেছে। এলাকার পুরুষ কাউন্সিলররা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি, তিনিও কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেননি বলে জানিয়েছেন।
নার্গিস বেনারকে বলেন, “আমাদের অফিস ভাড়া নিতে বলা হয়েছে। এ জন্য আট হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। আট হাজার টাকায় কি অফিস ভাড়া নেওয়া সম্ভব?”
“পুরুষ কাউন্সিলরা থানার সঙ্গে একটি কক্ষে জায়গা করে নিয়েছে। আমি জায়গা পাইনি। বাসায় বসে দাপ্তরিক কাজ কি করা যায়?” প্রশ্ন রাখেন নার্গিস।
নার্গিস আরও জানান, তিনি অন্যান্য নারী কাউন্সিলরদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। মাস দুয়েকের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন না হলে তখন ভেবে-চিন্তে কিছু একটা ‘সিদ্ধান্ত’ নেবেন।
এসব বিষয়ে জানতে দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বেনারকে তিনি বলেন, “আমার নীতিগত সিদ্ধান্ত হলো নারী কাউন্সিলরা কাজ করবেন। এর মধ্যে দুটি কমিটি হয়েছে। দুটিতেই ২৫ ভাগ কোটা করেছি নারীদের জন্য।” উচ্চ আদালতের নির্দেশ মেনে সব কাজে তিনি নারীদের শিগগির যুক্ত করার কথাও জানালেন।