বাংলাদেশ–ভারত একে অন্যের ভূখণ্ড ব্যবহার করবে, গড়ে উঠবে চার দেশীয় আঞ্চলিক সড়ক নেটওয়ার্ক

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.06.02
BD-connectivity কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা ও ঢাকা-গুয়াহাটি রুটে যাত্রাবাহী বাস চলাচলে ভারতের সঙ্গে চুক্তি ও প্রটোকল স্বাক্ষরের প্রস্তাবে সায় দিয়েছে সরকার। ১ ​ জুন মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ দুটি বিষয় অনুমোদন পায়। ​
বেনার নিউজ

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি সইয়ের ৪৩ বছর পর বাংলাদেশ-ভারত একে অন্যের ভূখণ্ড ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে বাণিজ্যের জন্য পণ্য ব্যবহারের সুযোগ পাবে। আর পণ্য পরিবহনের জন্য এক দেশ অন্য দেশকে মাশুলও দেবে।

এর পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার চার দেশ বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দুদিনের ঢাকা সফর উপলক্ষে এসব বিষয়গুলো সামনে আসছে।  প্রথম দিনেই অর্থাৎ ৬ জুন বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক শেষে পাঁচ বছরের জন্য নবায়ন হবে বাণিজ্য চুক্তি ও অভ্যন্তরীণ নৌ-বাণিজ্য ও ট্রানজিটের প্রটোকল। এ ছাড়াও ওই দিন চালু হবে আগরতলা-ঢাকা-কলকাতা বাস সার্ভিস।

আনুষ্ঠানিকতা শুরুর আগে কলকাতা-ঢাকা-আগরতলার মধ্যে গতকাল ১ জুন থেকে পরীক্ষামূলকভাবে বাস ছেড়েছে। ভারতীয় সময় সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বাসটি সল্টলেকের আন্তর্জাতিক বাস টার্মিনাল থেকে ছাড়ে। বাসটি ঢাকা হয়ে ২ জুন সকালে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় পৌঁছাবে। ওই দিন বিকেলে আগরতলা থেকে রওনা হয়ে পরদিন বুধবার সকালে কলকাতায় পৌঁছাবে।

কলকাতা ও আগরতলা থেকে এই বাস সপ্তাহে তিন দিন করে চলবে। কলকাতা থেকে সোম, বুধ ও শুক্রবার ছাড়বে। আর আগরতলা থেকে এই বাস ছাড়বে মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনিবার।

“আগামী ৬ জুন থেকে নিয়মিতভাবে এই পরিষেবা শুরুর জন্য আমরা প্রস্তুত। আসা বা যাওয়ার ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে দুই হাজার রুপি,” সাংবাদিকদের জানান কলকাতার শ্যামলী যাত্রী পরিবহনের মালিক অবনি ঘোষ।

আগামী ৪ জুন পশ্চিমবঙ্গের সচিবালয় নবান্ন থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে এই পরিষেবা শুরু করবেন। ওই সময় ওই বাসে ৩৫ জন ভারতীয় সাংবাদিক ঢাকা আসার কথা রয়েছে।

আগরতলা থেকে কলকাতার দূরত্ব প্রায় এক হাজার ৬৫০ কিলোমিটার। এই পরিষেবা চালু হলে দূরত্ব কমে দাঁড়াবে মাত্র ৫১৩ কিলোমিটারে। কলকাতা থেকে পশ্চিমবঙ্গ ভূতল পরিবহন নিগমের লাইসেন্স নিয়ে শ্যামলী যাত্রী পরিবহন এই পরিষেবা চালাবে এবং ঢাকা থেকে পরিষেবাটি চালাবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার (বিআরটিসি) লাইসেন্স নিয়ে শ্যামলী পরিবহন।

এর পাশাপাশি ঢাকা-শিলং-গৌহাটি রুটে আগামী ২২ মে পরীক্ষামূলক বাস চলাচল শুরুর আলোচনা চলছে। এ লক্ষ্যে চুক্তি সইয়ের জন্য দ্রুত কার্যক্রম এগিয়ে নিতে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে।

“দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বহুমুখী উন্নয়নে মোদি সরকারের আন্তরিকতা অভিনন্দনযোগ্য,” বেনারকে জানান সরকারের বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, যিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলে অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি।

পণ্য পরিবহন ও নৌ প্রটোকল:
বাণিজ্য ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, দুই পক্ষ আন্তর্জাতিক চুক্তি, সনদ ও রীতি অনুসরণ করে আলোচনার ভিত্তিতে দুই দেশ পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রানজিটের মাশুলের হার ঠিক করবে।

দুই পক্ষের সম্মতিতে তৃতীয় দেশে পণ্য পরিবহন ও মাশুলের প্রস্তাব যুক্ত করে বাণিজ্য চুক্তিতে পরিবর্তন আনা হয়। সংশোধিত চুক্তিটি পাঁচ বছরের জন্য নবায়ন হবে। বাণিজ্য চুক্তিতে পরিবর্তন আনায় নৌ-প্রটোকলেও তৃতীয় দেশে পণ্য পরিবহন ও মাশুলের বিষয়টি যুক্ত করা হয়।

গত ১৮ মে বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় সংশোধিত নৌ-প্রটোকল পাস হয়। গত ১৯ মে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন এ দুটি বিষয় বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। এতে অনিশ্চয়তা দেখা দেয় নৌ-প্রটোকল নিয়ে। শেষ পর্যন্ত গত ২৮ মে ভারত অবস্থান পরিবর্তন করায় নৌ-প্রটোকল নিয়ে অনিশ্চয়তার অবসান হয়।

“সংশোধিত বাণিজ্য চুক্তি অনুযায়ী ভারতের সড়ক, নৌ ও রেলপথ ব্যবহার করে নেপাল বা ভুটানের মতো তৃতীয় কোনো দেশে বাংলাদেশ পণ্য পরিবহন করতে পারবে। এটি বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন। ভারতও বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে পারবে,” বেনারকে জানান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা।

তিনি বলেন, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি ও নৌ-প্রটোকলে আলোচনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রীতি অনুসরণ করে ট্রানজিট মাশুলের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

“বিশ্বায়িত পৃথিবীতে আমরা যদি আমাদের কাজ, বিনিয়োগ, রপ্তানি এবং মানুষে–মানুষে যোগাযোগের জন্য যদি বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ চাইতে পারি, তাহলে প্রতিবেশীদের সঙ্গেও তা হওয়া প্রয়োজন। সেই বিবেচনাতেই আঞ্চলিক যোগাযোগের বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ,” বেনারকে জানান সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হ‌ুমায়ূন কবির যিনি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

“ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে চায়। এতে বাংলাদেশের সহযোগী হওয়া উচিত,” মনে করেন ওই কূটনীতিক।

আঞ্চলিক সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা

ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোর আদলে দক্ষিণ এশিয়ার চার দেশ বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। তবে এই যোগাযোগ ব্যবস্থা পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

এ লক্ষ্যে আগামী ১৫ জুন ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে চার দেশের সচিব পর্যায়ের বৈঠক ‘মোটর ভেহিকল ট্রান্সপোর্ট এগ্রিমেন্ট’ শীর্ষক একটি চুক্তি স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে।

“এ চুক্তির ফলে ইইউ দেশগুলোর আদলে এই চারটি দেশের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এবং অতি দ্রুত তা বাস্তবায়ন হবে,” বেনারকে জানান সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

সম্প্রতি ভারতের রাজধানী দিল্লিতে সফর করেন বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ সময় ভারত সরকারের সড়ক পরিবহন, মহাসড়ক ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রী নিতিন গাদকারির সঙ্গে বৈঠকে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি চার দেশের সড়ক পরিবহন বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়।

বর্তমানে সড়ক পথে নেপাল বা ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি কোনো যোগাযোগ নেই। তবে সীমান্তে গিয়ে গাড়ি বদলে ভারত হয়ে নেপাল বা ভুটানে যাওয়া যায়।

“নেপাল-ভুটানকে নিয়ে সড়ক-রেল যোগাযোগের যে কথা উঠছে, সেটা ইতিবাচক। মনে রাখতে হবে, আরও বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে আমরা তিনটি শক্তিকে উত্থানের মুখে দেখতে পাচ্ছি: চীন, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সম্মিলিত সংস্থা তথা আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো,” জানান হ‌ুমায়ূন কবির।

ওই কূটনীতিকের মতে, “ভারতের সঙ্গে যে কানেকটিভিটির কাজ আমরা করছি, তা হলো প্রথম স্তর। দ্বিতীয় স্তরে যেতে হলে বাংলাদেশকে আসিয়ানের সঙ্গে কানেকটিভিটি তৈরি করতে হবে, তৃতীয় স্তরে করতে হবে চীনের সঙ্গে। ভারতের হয়তো এ ব্যাপারে স্পর্শকাতরতা আছে, তবু বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি ভারতকে বোঝাতে হবে।”

“বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। আমরা দুই দেশের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের দেয়াল ভেঙে সৌহার্দ্যপূর্ণ সেতুবন্ধন রচনা করতে চাই,” জানান ওবায়দুল কাদের।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।