৩০ লাখ মামলার ভারে জজর্রিত বিচারব্যবস্থা, প্রধান বিচারপতির মন্তব্যে প্রতিক্রিয়া
2015.06.02
বিচারব্যবস্থা নিয়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সাম্প্রতিক কিছু মন্তব্য সরকার, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ৩০ লাখ মামলার ভারে জজর্রিত বিচারব্যবস্থার জন্য প্রধান বিচারপতি প্রকাশ্যে অনেককেই দায়ী করলেন।
গত ১৬ মে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ এর আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি বলেন, “আমাদের খুবই কষ্ট হয়, আইনজীবীর ত্রুটির জন্য শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ মামলায় বিচারপ্রার্থীরা হেরে যায়।
প্রধান বিচারপতির এই মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন আইনজীবীরা। পরদিন ১৭ মে আইনজীবী সমিতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “প্রধান বিচারপতির এ বক্তব্যের বিষয়ে আমরা, দেশের সব আইনজীবী প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা আইনজীবীরা সব সময় চেষ্টা করি মানুষ যাতে ন্যায়বিচার পায়।”
এর জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, “আমি ইচ্ছা করে কাউকে আঘাত দিতে চাইনি। আমি যা বলতে চাই তাহলো বিচার বিভাগ হচ্ছে রাষ্ট্রের একটা অঙ্গ। আমরা চাই তাদের (নির্বাহী বিভাগ) সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে সামঞ্জস্য রেখে চলতে।”
গত ৩০ মে বাংলাদেশ মহিলা জজ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতিকে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি আবারও বলেন, “যখন একেবারেই অসম্ভব হয়ে যায়, সহ্যের সীমা চলে যায়, তখন একজনকে তো বলতেই হবে। অনেক বিচারক মুখ বুঝে সহ্য করে যাচ্ছেন, তাদের বুক ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু কথা বলতে পারছেন না।”
“আমরা বিচারকরা ট্রেড ইউনিয়নের মতো দাবি-দাওয়া নিয়ে হাজির হবো না। আমি ইচ্ছে করে কাউকে আঘাত দিতে চাইনি। আমি যা বলি সেটা হলো, বিচার বিভাগ একটা রাষ্ট্রের একটা অঙ্গ,” জানান প্রধান বিচারপতি ।
এসময় বাংলাদেশের বিচার বিভাগ আধুনিক প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকায় মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন তিনি এবং আইনমন্ত্রীকে আধুনিক প্রযুক্তিতে বিচার বিভাগের উন্নয়ন করার জন্য আহ্বান জানান।
আইনমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, “জনপ্রশাসনে সব অফিসারের ডাটা আছে। যেটা বিচার বিভাগে নেই। সুপ্রিমকোর্টে তালিকা আপডেট করছি।”
তবে মন্ত্রনালয়ের প্রস্তাব ছাড়া এটা কার্যকর হবে না। মামলা নিষ্পত্তির জন্য কোনও এডিশনাল জজের পদ খালি রাখা যাবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
প্রধান বিচারপতির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, “খোদ বাংলাদেশের বিচার-ব্যবস্থার কাঁধে প্রায় ৩০ লাখ অনিষ্পন্ন মামলার বোঝা চেপে আছে। এর প্রায় ৬০ শতাংশই ভূমি বিরোধ সংক্রান্ত মামলা।”
গত ২৫ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা বিষয়ক এক সেমিনারে এই তথ্য দেন। এসময় তিনি বলেন, “দীর্ঘকাল ধরে এসব মামলা চলাও বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে এক ধরনের বঞ্চনা। এর কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মামলার ব্যয় অত্যাধিক।”
১ জুন পৃথক অনুষ্ঠানে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, “বিচারকাজে দীর্ঘসূত্রিতা বিচার প্রত্যাশীদের জন্য কুফল বয়ে আনে। এ কারণে বিচারকদের নিষ্ঠার সঙ্গে এবং কালক্ষেপন না করে বিচারকাজ পরিচালনা করতে হবে।”
২০১১ সালের শেষে সব আদালত মিলিয়ে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ছিল ২১ লাখ ৩২ হাজার ৪৬টি মামলা। ২০১৩ সালের শুরুতে বিচারাধীন মামলা ছিল ২৪ লাখ ৫৪ হাজার ৩৬০টি।
এখন তা ৩০ লাখ হওয়ার কারন উল্লেখ করতে গিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, “আদালতের প্রক্রিয়াও দীর্ঘমেয়াদি। মামলা নিষ্পত্তিতে আইনজীবীদের অনীহা লক্ষ্য করা যায়। বেলা দুইটার পর আদালতে কোনো আইনজীবীকে পাওয়া যায় না।”
আবার জোটবদ্ধ হয়ে কোনো আদালত বা বিচারকের বিরোধিতা করা কিংবা আদালত বর্জনের প্রবণতাও আছে। প্রধান বিচারপতি এসব বিষয়ে আইনজীবীদের সহায়তা কামনা করেন। একইসঙ্গে তিনি গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানান মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্বের প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করার।
আমলাতান্ত্রিক কারণেও মামলা বিলম্বিত হয় উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, অনেক মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত ফাইল বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আটকে থাকে।
প্রধান বিচারপতি এই সমালোচনার ঢেউ আছড়ে পড়ে জাতীয় সংসদে। একাধিক সাংসদের প্রশ্নের জবাবে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক ১ জুন বলেছেন, দ্রুত মামলার জট কমাতে সরকার কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এর ফলাফল পাওয়া যাবে।
বিচার-ব্যবস্থায় জনবলের অভাব থাকার কথা উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, অধস্তন আদালতগুলোয় সহকারী জজ থেকে জেলা জজ পর্যন্ত মোট অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১ হাজার ৬৫৫টি। এর মধ্যে বর্তমানে ৪৫৭টি পদ শূন্য।
সবচেয়ে বেশি শূন্য পদ যুগ্ম জেলা জজ ও সমপর্যায়ে, ২৭৬টির মধ্যে ১৩০টি শূন্য। অথচ বেশির ভাগ মামলা নিষ্পত্তি এই পর্যায়েই হওয়ার কথা।
“শূন্য পদগুলো পূরণ করার প্রক্রিয়া চলছে। মন্ত্রনালয় এই চেষ্টা অব্যহত রেখেছে।” বেনারকে জানান আইন মন্ত্রনালয়ের উপ সচিব মো. মিজানুর রহমান।
প্রধান বিচারপতি বলেন, “রাষ্ট্র অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের আইন সহায়তা দেয় সবার জন্য বিচার পাওয়ার সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে। এই সহায়তা কোনো দাতব্য বিষয় নয়। এটা মানুষের অধিকার।”
বাংলাদেশে এ অধিকার নিশ্চিত করতে হলে বিচার-ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, এই সংস্কারে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার মামলা ব্যবস্থাপনা ও আদালত প্রশাসন বিষয়ে।
সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, “অনেক সময় দেখা যায় মামলার তদন্তে প্রকৃত আসামিদের বাদ দিয়ে পুলিশ আদালতে প্রতিবেদন দেয়। এতে মামলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।” পুলিশকে মামলার সঠিক তদন্ত করে বিচার প্রার্থীদের ন্যায় বিচার পেতে সহযোগিতা করতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
“বিচার-ব্যবস্থা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর যে সক্ষমতা থাকা দরকার তা নেই। এ ক্ষেত্রে কিছু সুনির্দিষ্ট বাধা হচ্ছে মামলার ব্যয়, দুর্নীতি, অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তার এবং বিচার পাওয়ার আইনি অধিকার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাব।” বেনারকে জানান সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক।
সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর এক অভিভাষণে বলেন, “আদালতের পূর্ণাঙ্গ সময়টুকু বিচার ও শুনানির কাজে লাগালে শুধু মামলা নিষ্পত্তির হারই বৃদ্ধি পাবে না, মামলাজটও কমবে। এতে বিচারপ্রার্থী জনগণ দীর্ঘ হয়রানি থেকে মুক্তি পাবেন।”
“ জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা আইন সহায়তার কাজে অংশ নিতে সাধারণত রাজি হন না। ফলে মানসম্পন্ন আইন সহায়তা পাওয়া নিশ্চিত করা যায় না। এ ব্যাপারে জনগণের সচেতনতাও কম। আইনজীবী সমিতিগুলোর ভূমিকাও হতাশাজনক।” বেনারকে জানান সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার সৈয়দ আমিনুল ইসলাম।
“মানুষ বাড়ছে, মানুষের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদও বাড়ছে। ফলে মামলার সংখ্যাও বাড়ছে। মামলাজটের দায় কেউ এড়াতে পারেন না।” সম্প্রতি এক সেমিনারে জানান এটর্নী জেনারেল মাহবুবে আলম।
তার মতে, শুনানি করে রায় দিতে হয় ও লিখতে হয়। রায় লিখতে সময় লাগে। এক্ষেত্রে অফিসিয়াল সিস্টেম অনেকটা দায়ী। এ ছাড়া সহায়ক স্টাফদেরও অদক্ষতা রয়েছে।