দিনে দিনে বাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে ঢাকা
2015.07.06

কর্মসংস্থানের আশায় একদিকে গ্রাম থেকে মানুষ রাজধানীমুখি হচ্ছে। অন্যদিকে, যানজট, বৃষ্টির পানি ও আবাসিক সংকটে ঢাকা শহর ক্রমাগত বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। নাগরিক সুবিধা দিন দিন হচ্ছে সংকুচিত আর জীবন-যাপন হয়ে উঠছে দুর্বিসহ।
মিরপুরের পল্লবী থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত বাস রুটটির দূরত্ব ১৪ দশমিক ৭ কিলোমিটার। সময় লাগার কথা বড়জোর ৩০–৪০ মিনিট। কিন্তু আজকাল যানজটের কারণে সময় লাগে দুই ঘণ্টা বা তারও বেশি।
শুধুই কি যানজট? সামান্য বৃষ্টিতে ঢাকার বেশির ভাগ এলাকা ডুবে যায়। শহরের বড় অংশজুড়ে অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। ময়লা-আবর্জনাতো আছেই। বিশুদ্ধ পানির সংকট, মশা–মাছির উপদ্রব তো ঘরে ঘরে।
এসব পরিস্থিতি বিবেচনায় ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্য নগরীর তালিকায় ফেলা হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জরিপেও ঢাকাকে অন্যতম নিকৃষ্ট শহর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গত মে মাসে প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)’-এর তালিকায় বিশ্বে বসবাসের ‘সবচেয়ে অযোগ্য’ ১০টি শহরের তালিকায় টানা দ্বিতীয়বারের মতো দ্বিতীয় স্থান পায় ঢাকা। শীর্ষে রয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক।
গত বছরের মার্চে প্রকাশিত বিশ্বের বিভিন্ন শহরের ওপর করা যুক্তরাষ্ট্রের সমীক্ষাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান মারসারের এক তালিকায় জীবন যাপনের মানের ক্ষেত্রে এশিয়ার দ্বিতীয় নিকৃষ্ট শহর হিসেবে ঢাকার নাম উঠে এসেছে। বাকি শহরগুলো হলো তাজিকিস্তানের দুশানবে, তুর্কমেনিস্তানের আশখাবাদ, কিরগিজস্তানের বিশকেক ও উজেবেকিস্তানের তাসখন্দ।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অপরাধ, দূষণসহ বেশ কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বের ৪৬০টি শহরের তথ্য নেওয়া হয়। পরে ২২৩টি শহর নিয়ে মূল তালিকাটি তৈরি করে মারসার।
দিনে দিনে আরো ঢাকার অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে
“আমাদের সরকার বা কর্তৃপক্ষ মনে হয়, নগরবাসীকে কষ্ট দিতে আনন্দ পায়। না হলে মেগাসিটি বলা হয় যে শহরকে, সেই শহরে এত অব্যবস্থাপনা থাকে কী করে? সবচেয়ে আশঙ্কার কথা হলো, দিন দিন এটা আরও খারাপ হচ্ছে,” বেনারকে জানান নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।
গত ২৮ এপ্রিল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের পর মানুষ আশা দেখতে শুরু করেন। কিন্তু গত কয়েক দিন আগে টানা কয়েক দিনের বর্ষণে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। বৃষ্টিতে পানি জমে যাওয়ার কারণে অলিগলির রাস্তাগুলো বেহাল হয়ে পড়ে।
“জলাবদ্ধতার সমস্যা দূর করতে এখন পর্যন্ত কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ দেখাতে পারেননি দুই মেয়র,” জানান পুরোনো ঢাকার মৌলভীবাজার এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম (৪৫)।
এ বিষয়ে উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক বেনারকে বলেছেন, “জলাবদ্ধতা কবে যাবে, এর উত্তর আমার জানা নেই। তিনি জলাবদ্ধতার জন্য কিছু আবাসন প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করেন।”
অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বেনারকে বলেন, “বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়টা খুব জরুরি। এই চেষ্টা শুরু করেছি, কয়েক মাসের মধ্যে পরিস্থিতির কিছু উন্নয়ন ঘটবে।”
ঢাকায় ৫৬টি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা রয়েছে। এগুলো আটটি মন্ত্রণালয়ের অধীন। প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয় তাদের নীতি অনুযায়ী তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করে। ফলে দুই মেয়রের পক্ষে ৫৬টি প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দেওয়া সম্ভব নয়।
দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা হচ্ছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসার মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে জলাবদ্ধতা এখন নিয়মিত দুর্ভোগে পরিণত হয়েছে। কারণ রাজধানীর রাস্তাগুলো দেখভাল করে সিটি করপোরেশন। কিন্তু রাস্তার পানি সরানোর কাজটি করে ঢাকা ওয়াসা। অথচ এই দুই সংস্থার মধ্যে সমন্বয় নেই।
“নগরের এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় পয়োব্যবস্থা রাখা হয়নি। তার ওপর বক্স কালভার্ট করে খাল ভরাট করা হয়েছে। নিম্নাঞ্চলের বন্যাপ্রবাহ এলাকা, যেখান থেকে পানি নেমে যাবে, সেখানে বালু ফেলে ভরাট করে আবাসন প্রকল্প ও বাড়ি উঠেছে। এই সংকট থেকে বের হওয়া সহজ নয়,” জানান সাঈদ খোকন।
প্রয়োজন নগর সরকার গড়ে তোলা
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে নগরে জনসংখ্যা ৫০ লাখ অতিক্রম করবে সেই নগরে নগর সরকার গঠন করা দরকার। নগর সরকার হবে একটি পৃথক প্রশাসনিক কাঠামো। নগর সংসদ, নগর প্রশাসন ও নগর আদালত মিলে নগর সরকার গঠিত হবে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমদে বেনারকে বলেন, “মেয়র নগর সরকারের প্রধান হবেন। কাউন্সিলররা নগর সংসদের সদস্য হবেন। এই সংসদ শুধু নগরের জন্য নীতি প্রণয়ন করবে”।
তিনি আরো জানান, “নগরীর সব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নগর সরকারের অধীন হবে। মেয়র নগরীর মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী নগরীর উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবেন বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে। নগর পুলিশের মাধ্যমে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করবেন”।
“পরিকল্পিতভাবে চার-পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকাকে একটি আধুনিক শহরে পরিণত করা সম্ভব। তবে রাজধানীর সঙ্গে সঙ্গে সমান্তরালভাবে সারা দেশের উন্নয়ন করতে হবে। তাহলে উন্নয়ন সুষম হবে,” জানান স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন।
যানজটে অতীষ্ঠ মানুষ
এখন রোজার মাসে ঢাকাবাসী যানজটে বিরক্ত হচ্ছে। রোজাদার অনেকেই রাস্তায় ইফতার করতে বাধ্য হচ্ছেন। জরুরি চিকিৎসার জন্য হাসপাতালমুখী রোগীদের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে যানজটে পড়ে।
৬ জুন মিরপুর থেকে আসা শিকড় পরিবহনের একটি বাস ফার্মগেটের কাছে এসে যানজটে পড়ে আটকে যায়। বাসটির সামনের ইঞ্জিন কভারের ওপর বানানো সিটে বসে গরমে গলদঘর্ম হচ্ছিলেন কয়েকজন যাত্রী।
এ সময় নিজেদের মধ্যে যানজটের সমস্যা নিয়ে আলাপ শুরু করে দেন তাঁরা। একজন বলতে থাকেন যানজটের কারণে ঢাকা শহরই ছেড়ে দিতে হবে।
আরেকজন বললেন, মিরপুর থেকে গুলিস্তান যেতে প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে যায়। বাসায় ফিরতে আরও দুই ঘণ্টা। এরপর শারীরিক ধকল তো আছেই।
“৪০০ বছরের পুরোনো ঢাকা বদলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, সম্প্রসারিত হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। জীবনযাত্রায় দুর্ভোগ বাড়ছে। এ থেকে পরিত্রাণের পথ সামনে এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না,” জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবদুল মোমিন চৌধুরী।