গুমের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.10.20
161020-BD-protest-1000.jpg গুম হওয়া মানুষদের খোঁজে ছবি হাতে ঢাকা প্রেস ক্লাবের বাইরে মানববন্ধন করেন স্বজনেরা। ডিসেম্বর ৯, ২০১৪।
এএফপি

চলতি বছর আগস্টের ৪, ১০ ও ২২ তারিখে বিএনপি ও জামায়াতের তিনজন যুদ্ধাপরাধীর সন্তানকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা কোথায় আছেন, বেঁচে আছেন, না মারা গেছেন—এসব প্রশ্নের জবাব মিলছে না রাষ্ট্রীয় কোনো বাহিনীর কাছ থেকে।

গত ৪ আগস্ট হুম্মাম কাদের গাড়ি চালিয়ে পুরান ঢাকার আদালত পাড়ায় যাচ্ছিলেন। হুম্মামের স্বজনেরা বলেন, সিগন্যালে তার গাড়িটি আটকা পড়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে একদল লোক তাকে গাড়িতে তুলে নেয়।

বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য হুম্মাম কাদের চৌধুরী বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।

হুম্মাম গুম হওয়ার  ছয়দিন পর মীর কাশিম আলীর ছেলে ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মীর আহমেদ বিন কাশিমকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তার বাসা থেকে। মীর কাশিম আলীরও ফাঁসি হয়েছে একই অপরাধে।

একইভাবে ২২ আগস্ট যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতে ইসলামীর প্রয়াত আমির ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমের ছেলে সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুল্লাহিল আমান আজমীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

স্বজনেরা বলছেন, তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয় দিলেও কেউ কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেখায়নি।

তবে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “হুম্মাম কাদের, মীর আহমেদ বিন কাশিম বা আবুদুল্লাহেল আমান আজমি আমাদের কাছে নেই।”

জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব অল পার্সনস  ফ্রম এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ২০০৬ অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় অনুমোদন, সাহায্য অথবা মৌন সম্মতিতে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার, বিনা বিচারে আটক, অপহরণ অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করা এবং আইনি রক্ষাকবচের বাইরে ওই ব্যক্তির নিয়তি বা অবস্থানের তথ্য গোপন রাখা হলে ধরে নিতে হবে ওই ব্যক্তি গুম হয়েছেন।

সাত মাসে ৭০ গুম!

এ বছরের প্রথম সাত মাসে গুম হয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে ৭০ জন, আরেক মানবাধিকার সংগঠন অধিকার বলছে, প্রথম আট মাসে এই সংখ্যা ৫৫। আসক বলছে, ২০১৫ সালে ৫৫ জন গুম হয়েছিলেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বেনারকে বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করছে। গুমের সঙ্গে তারা জড়িত নয় এবং তাদের বিরুদ্ধে এমন স্পর্শকাতর অভিযোগ ভিত্তিহীন।”

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, “আমরা গুমের অনেকগুলো অভিযোগ তদন্ত করে দেখেছি। দেখা গেছে, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে ও বিব্রত করতে অনেকেই স্বেচ্ছায় লুকিয়ে থাকে।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, "তিন যুদ্ধাপরাধীর সন্তানেরাও পিতার ফাঁসি ঠেকাতে না পেরে হয়তো লুকিয়ে আছে।"

গুমের তালিকায় জঙ্গিসহ সবাই

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের আগে বিএনপি জামায়াতের নেতা–কর্মীদের অনেকে গুম হন। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর এক দিনে আটজনকে দুই দফায় র‍্যাব  পরিচয়ে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

এ বছরের ৩ মার্চ সাজেদুল ইসলাম সুমনের স্বজনেরা হাইকোর্টে রিট করেন। বিচারপতি সৈয়দ মুহাম্মদ দস্তগীর হুসেইন ও বিচারপতি এ কে এম শহিদুল হকের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, র‍্যাবের মহাপরিচালকসহ বিবাদীদের রুলের জবাব দেওয়ার নির্দেশ দেন।

সাজেদুল ইসলামের বোন সানজিদা ইসলাম বেনারকে বলেন,“আমার মা বুড়ো হয়েছেন। আমি আমার মা-বোনকে নিয়ে তিন দিন র‍্যাব-১-এর সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছি। আজ দুই বছর সাত মাস ধরে তারা একই কথা বলে যাচ্ছে। অথচ সবার সামনে বেধড়ক পিটিয়ে আমার ভাইকে গাড়িতে তোলা হয়েছিল।”

বেনারের এক প্রশ্নের জবাবে র‍্যাব এর মিডিয়া ও লিগ্যাল উইং শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান র‍্যাবের বিরুদ্ধে ওঠা গুমের অভিযোগ অস্বীকার করেন।

অন্যদিকে বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেনারকে বলেন, “আধিপত্য বিস্তারের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার গুমের রাজনীতি করছে। তাদের আমলে ২০০৯ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত কমিশনার চৌধুরী আলম গুম হন। ২০১২ সালে গুম হন সাংসদ ইলিয়াস আলী ও তার গাড়ি চালক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।”

গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের কারণে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন নেতাও গুম হয়েছেন। ছাত্রলীগের নেতা শেখ মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন তপুকে গত ৫ ফেব্রুয়ারি তাদের বাড্ডার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা বরাবর তপুকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করছে।

জঙ্গি সন্দেহে তুলে আনা ও পরে গ্রেপ্তার দেখানোর ঘটনা ঘটছে উল্লেখযোগ্য হারে। কখনও গুম হওয়ার পর পাওয়া যাচ্ছে লাশ।

গত ১২ মে একই দিনে তিন ব্যক্তিকে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় খুলনা থেকে। তাঁদের একজন কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক মো. আবদুল্লাহ আল সাঈদ তূর্য, মাদ্রাসা শিক্ষক মোঃ শোয়াইব বিশ্বাস ও বিদ্যুৎ মিস্ত্রি মনিরুল ইসলাম বাবু।

তূর্যের বাবা মো. শহীদুল ইসলাম ওই ঘটনায় মামলা দায়ের করেন। একমাস পর আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য হিসেবে তাঁদের যাত্রাবাড়ী থেকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বেনারকে বলেন, “সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আইন-কানুন মেনে পুলিশ কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করে থাকে। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।”

১৮ মার্চ ঝিনাইদহ শিবিরের সভাপতি আবুজার গিফারি ও শিবিরকর্মী শামীম হোসেন চাপালী কালীগঞ্জ থেকে নিখোঁজ হন। ১৩ এপ্রিল যশোরের লাউখালী এলাকার শ্মশান থেকে তাদের লাশ উদ্ধার হয়।

তবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বেনারকে বলেন, “গুমের অভিযোগ পেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে লেখা হচ্ছে। কোনো কোনো গুমের ঘটনা অত্যন্ত ভয়ংকর। কখনো কখনো গুম হওয়ার কিছুদিন পর কোনো একটি ঘটনায় গ্রেপ্তার বা সংশ্লিষ্টতা দেখিয়ে তাদের জনসমক্ষে আনা হচ্ছে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পক্ষে যায় না।”

মানবাধিকার কর্মীদের উদ্বেগ

ধারাবাহিকভাবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও দেশীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো গুমের বিরুদ্ধে কথা বললেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।

আইন ও সালিস কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “গুমের ঘটনা পাত্তা না দেওয়ায় সাতখুনের মতো ঘটনা ঘটেছিল। অপরাধী বা নিরীহ মানুষ প্রত্যেকের বিচার পাওয়ার অধিকার আছে।”

তিনি বলেন, “আমরা গুমের ঘটনাগুলো তদন্ত করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সত্যতা পেয়েছি।”

“আমাদের দেশে এই গুমের সংস্কৃতি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বড় প্রতিবন্ধক। সভ্য দেশে গ্রেপ্তার ও আদালতে তোলার সময়ের মধ্যে অসংগতি দেখলে মামলাই খারিজ হয়ে যায়,” বেনারকে জানান সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।