চার দশক পর নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদায় বাংলাদেশ

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.07.03
BD-economics বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক র‍্যাংকিং-এ বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। জুলাই,২০১৫
বেনার নিউজ

রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিনিয়োগে স্থবিরতাসহ বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বেরিয়ে  বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার মর্যাদা পেয়েছে। স্বাধীনতার পর গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের তালিকাতেই ছিল। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক র‍্যাংকিং-এর তালিকায় এই তথ্য দেয়া হয়।

নতুন তালিকায় চারটি দেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের তালিকায় ঢুকতে পেরেছে। বাংলাদেশ ছাড়াও আছে কেনিয়া, মিয়ানমার ও তাজিকিস্তান। সার্কভুক্ত অপর দুইদেশ ভারত ও পাকিস্তান আগেই নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে অন্তর্ভুক্ত হয়।

বাংলাদেশ সরকারের ১০ বছরের প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার কথা বলা আছে।  তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলছেন, তার আগেই মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে বাংলাদেশ।

“মধ্যম আয়ের দেশ হতে ২০২১ লাগবে না। আগামী তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশ সেই লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে। ২ জুন গণভবনে আয়োজিত ভিডিও কনফারেন্স অনুষ্ঠানে এমন মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কোন দেশ নিম্ন আয়ের, আর কোন কোন দেশ উচ্চ বা মধ্যম আয়ের, তা নির্ধারণ করে বিশ্বব্যাংক। মূলত কোন দেশগুলোকে তারা কী ধরনের ঋণ দেবে, সেটা ঠিক করতেই এই শ্রেণিবিন্যাস করা হয়।  

“বার্ষিক মাথাপিছু আয়ের নিরিখে স্ট্যাটাসে এ পরিবর্তন আনা হয়েছে। বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, আমাদের যে মাথাপিছু আয় বেড়েছে-তার আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি এটি,” জানান ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন।

বিশ্বব্যাংকের পরিমাপ অনুযায়ী, ১ হাজার ৪৫ ডলার থেকে ১২ হাজার ৭৩৫ ডলার পর্যন্ত মাথাপিছু জাতীয় আয় হলে একটি দেশ মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় ঢুকে পড়বে।  

তবে যেহেতু সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ আয়ের মধ্যে পার্থক্যটি অনেক বড়, তাই মধ্যম আয়কে আবার দুটি উপখাতে ভাগ করেছে বিশ্বব্যাংক। আর এই ভাগ অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় ঢুকেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় (জিএনআই) এখন ১ হাজার ৩১৪ ডলার। তবে বিশ্বব্যাংকের পরিমাপ পদ্ধতিতে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৮০ ডলার। অর্থাৎ সামান্য ওপরে আছে বাংলাদেশ।  

তিনটি কারণে   বাংলাদেশের এই অর্জন এসেছে। প্রথমত: প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে ৬ শতাংশ হওয়ায় গড়ে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৪ শতাংশ হারে। দ্বিতীয়ত, জাতীয় আয়কে সূচক হিসেবে নেওয়ায় প্রবাসী-আয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ফলে আয়ও বেশি দেখানো যাচ্ছে।  

আর তৃতীয়ত, ডলার ও টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকার সুবিধাও বাংলাদেশ পেয়েছে। অতীতে দেখা গেছে, ডলারের তুলনায় টাকার অবমূল্যায়ন হয় এবং এতে টাকায় জাতীয় আয় বাড়লেও ডলারে তা বাড়ে না।

প্রতিবছর ১ জুলাই বিশ্বব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে মাথাপিছু মোট জাতীয় আয় অনুসারে দেশগুলোকে চারটি আয় গ্রুপে ভাগ করে। যাদের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৪৫ ডলার বা তার নিচে, তাদের বলা হয় নিম্ন আয়ের দেশ ।

বিশ্বে এখন সব মিলিয়ে নিম্ন আয়ের দেশ ৩১টি, নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ ৫১টি, উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ ৫৩টি এবং উচ্চ আয়ের দেশ ৮০টি।  

যেসব দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১০৪৬ ডলার থেকে শুরু করে ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার, তারা মধ্যম আয়ের দেশের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে আবার আয় ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে শুরু করে ৪ হাজার ১২৫ পর্যন্ত হলে তা হবে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ এবং আয় ৪ হাজার ১২৬ ডলার থেকে শুরু করে ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার হলে দেশগুলোকে বলা হয় উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ।

এর চেয়ে বেশি মাথাপিছু জাতীয় আয় হলে সেই দেশগুলোকে বলা হয় উচ্চ আয়ের দেশ।

“জাতি হিসেবে এটি আমাদের জন্য অবশ্যই একটি বড় অর্জন ও মাইলফলকও বটে,” জানান বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান।

তাঁর মতে, দেশের ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উন্নয়নেরই প্রতিফলন ও স্বীকৃতি এটি।  এর ফলে আন্তর্জাতিক ঋণবাজার থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থা তৈরি হবে। বাংলাদেশকে এখন কম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে গণ্য করা হবে।

“অন্য দিক থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে শর্তও কিছুটা কঠিন হতে পারে। এ জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি রাখা দরকার,” জানান মোস্তাফিজুর রহমান।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে চলে গেলেও বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকাতেই থাকবে। ফলে এলডিসির সুবিধাগুলোও বহাল থাকবে।  

এ তালিকা থেকে বেরোতে হলে তিনটি সূচক অতিক্রম করতে হবে। যেমন: অর্থনীতির নাজুকতার সূচক, মানব উন্নয়ন সূচক ও মাথাপিছু আয়ের সূচক।  এর মধ্যে প্রথম সূচকটি  অতিক্রম করলেও অন্য দুই সূচক অতিক্রম করতে পারেনি বাংলাদেশ।

বিশ্বব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, নিম্ন মধ্যম আয়ের তালিকায় ঢুকলেও বাংলাদেশ সহজ শর্তের (আইডিএ) ঋণ পেতে থাকবে। যেমন এখন ৩৯ বছরে পরিশোধযোগ্য ঋণ পায় বাংলাদেশ। পরিশোধের জন্য বাড়তি আরও ৬ বছর দেওয়া হয়। আর সুদ দিতে হবে দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে।  

তবে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ২০০ ডলার হলে এই ঋণ আর পাবে না। তখন ৫ শতাংশের বেশি সুদে ঋণ নিতে হবে।

“মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার ফলে দেশ হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নত হবে। দেশের ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে এ অর্জন ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। কিন্তু তাতে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না,” বেনারকে জানান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জা আজিজুল ইসলাম।

তাঁর মতে, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে বাংলাদেশ যেসব সুবিধা পেয়ে থাকে, সেগুলো যেন অব্যাহত থাকে, এ ব্যাপারেও সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।

অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত এলডিসি থেকে উত্তরণ। কারণ, এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য আয় বাড়ানোর পাশাপাশি মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়।

“বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ায় আনন্দিত হলেও তৃপ্ত হতে পারছি না। এর কারণ, কেবল আয় বৃদ্ধিকে এখন আর উন্নয়ন বলা যায় না,” বেনারকে জানান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

তাঁর মতে, “আমরা এলডিসি থেকে উত্তরণকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ, এর সঙ্গে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনীতির ভঙ্গুরতার বিষয়টি জড়িত আছে।”

বিশ্বব্যাপী এখন নিম্ন আয়ের দেশের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। ১৯৯৪ সালে নিম্ন আয়ের দেশ ছিল ৬৪টি, এখন তা মাত্র ৩১টি।

বিশ্বে এখন সবচেয়ে বেশি আছে মধ্যম আয়ের দেশ। বেশির ভাগ মধ্যম আয়ের দেশ উচ্চ আয়ের হতে পারছে না। এই অবস্থাকে বলা হচ্ছে মধ্যম আয়ের ফাঁদ। রাশিয়া, চীন, ব্রাজিল বা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশও এ অবস্থা থেকে বের হতে পারেনি।

“মূলত যারা কেবল আয় বাড়াতেই বেশি মনোযোগ দিয়েছে এবং অবকাঠামো, শিক্ষাসহ মানবসম্পদ উন্নয়ন, রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামুখী থাকার দিকে নজর দেয়নি, তারাই আটকে আছে এই ফাঁদে,” জানান দেবপ্রিয়, যিনি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো।।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

বিশ্বব্যাংকের এই অবস্থান নির্ণয়ের পর এক প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের অনেক জ্বালাও-পোড়াও মোকাবিলা করতে হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি শ্লথ করতে পারেনি।”

এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো তার ছেলে জয়ও আশা করছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান মেয়াদের শেষ দিকেই বাংলাদেশ ‘উচ্চ-মধ্যম’ আয়ের দেশে পরিণত হবে।

৩ জুলাই ফেইসবুকে তিনি লিখেছেন, “বাংলাদেশ আর দরিদ্র দেশ নয়। যা এখন আনুষ্ঠানিকভাবে একটি মধ্যম আয়ের দেশ।”

তবে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বলেছে, এই অর্জনে সরকারের কোনো কৃতিত্ব নেই।

“এখানে সরকারের ধন্যবাদ পাওয়ার কিছু নেই, জনগণের প্রচেষ্টা ছিল। এটা জনগণের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফল,” বলেছেন বিএনপির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন।

বৃহস্পতিবার নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে একথা বলেন তিনি।

রিপন বলেন, “অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে আমাদের নারীরা তিন শিফটে কাজ করছে, জনগণ বন্যার পানি ডিঙিয়ে গরু-ছাগল রক্ষার জন্য কাজ করছে। বিদেশ থেকে যুবকরা দেশে এসে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে অর্থনীতি সচল করার চেষ্টা করছে।”

“মিথ্যা হিসাব দিয়ে দেশকে ‘মধ্য আয়ের দেশ’ বলে দাবি করা হচ্ছে। সব মানুষের আয় কি এক লাখ টাকা?এটা মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়,” জানান বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি  মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।

তাঁর মতে, সরকার ধনীকে আরো ধনী এবং গরিবকে আরো গরিব বানাচ্ছে। ‘মধ্য আয়ের দেশ’ হলেও এই গরীবের কোনো লাভ হবে না।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।