অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার ওপর গুরুত্ব আরোপ দাতাদের
2015.11.16
জ্বালানি-সংকট, অবকাঠামো দুর্বলতা এবং প্রতিযোগিতা-সক্ষমতার অভাব—বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই তিনটি চ্যালেঞ্জ থাকার কথা উল্লেখ করে সরকার ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধি এবং অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন, এগুলো মোকাবিলা না করতে পারলে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেগুলো অর্জন বেশ কঠিন হবে।
প্রায় ছয় বছর পর ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের (বিডিএফ) সভায় এই মত বেরিয়ে আসে। গত রোববার ও সোমবার ওই সভায় বাংলাদেশে অর্থায়নকারী উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর প্রতিনিধি ছাড়াও দাতা সংস্থা, সরকার ও বেসরকারি পর্যায়ের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। রোববার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেন।
এর আগে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফোরামের সর্বশেষ বৈঠক ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ উপলক্ষে ঢাকা সফর শেষে সোমবার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট ওয়েনচাই ঝাং জানান, আগামী তিন বছরে এডিবি বাংলাদেশে ৫০০ কোটি ডলার অর্থায়ন করবে।
“বাংলাদেশে এডিবির অর্থায়ন তো বাড়ছে । আগামী তিন বছরের বিজনেস প্ল্যান ঠিক করা হয়েছে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী, তিন বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে এডিবি,” জানান এডিবির ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের বৈঠকে যোগ দিতে ঢাকায় আসা ঝাং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে বৈঠক করেন।
গত তিন অর্থবছরে ম্যানিলাভিত্তিক এই অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে মোট ৩০০ কোটি ডলার অর্থায়ন করেছে। চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দিচ্ছে ১২০ কোটি ডলার।
তিনি বলেন, ৪২ বছর ধরে এডিবি বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করছে। এত দিনে এডিবির অর্থায়নে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে বা হচ্ছে, তাতে তারা সন্তুষ্ট।
বাংলাদেশে ওয়েনচাই ঝাংয়ের এটা দ্বিতীয় সফর। এর আগে ২০১৪ সালের নভেম্বর তিনি এসেছিলেন। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এডিবি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার আবাসিক প্রতিনিধি কাজুহিকো হিগুচিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন।
দুই সফরের মধ্যবর্তী সময়ে বাংলাদেশ কোন ক্ষেত্রে ভালো করেছে বলে চোখে পড়েছে- সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে ঝাং বলেন, “মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) এর লক্ষ্য অর্জন করাই বাংলাদেশের অন্যতম সাফল্য।
ঝাং বলেন, “আঞ্চলিক যোগাযোগ তথা এশিয়ান করিডর স্থাপনে বাংলাদেশ অবস্থানগত কারণেই ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ। এডিবি এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে।”
বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে বিশেষ করে গ্যাস খাতের উন্নয়নে (উৎপাদন, বিতরণ, সঞ্চালন) বিনিয়োগ করতে আগ্রহের কথা জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান ও আশাবাদ
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়ন ধারা এগিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সহায়তা অব্যাহত রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রোববার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরাম-২০১৫ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আমরা আমাদের সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে এ দেশের মানুষের সার্বিক উন্নয়নে বদ্ধপরিকর।”
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) পূরণে বাংলাদেশের সাফল্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আশা করছি- সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মতো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আমরা একইভাবে সফল হব।"
এসময় তিনি সুষম ও পারস্পরিক উন্নয়নের জন্য আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক, দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এ ক্ষেত্রে সার্ক, বিমসটেক এবং বিসিআইএম-এ বাংলাদেশের ভূমিকার কথাও তুলে ধরেন তিনি।
“আমাদের লক্ষ্য অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উচ্চ মধ্যম-আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা। উন্নয়নের এ অগ্রযাত্রায় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের পেলে আমরা আনন্দিত হব,” বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সম্প্রতি আমরা প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগ বৃদ্ধির সুবিধার্থে এ অঞ্চলের মধ্যে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজে হাত দিয়েছি। চারটি দেশের মধ্যে পণ্য পরিবহন শুরু হয়েছে।”
তিনি জানান, এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবেশ ও কারিগরি খাতে পারস্পরিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “১৯৯১ সালে আমাদের দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৬.৭ শতাংশ। আমরা সেই দারিদ্র্যের হার ২২.৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। অতি দারিদ্র্যের হার ৭.৯ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে।”
“এখন আমাদের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা। এ সময়ে দারিদ্র্যের হার ১৪ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।”
গত ছয় বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার তিনগুণ বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অর্থায়নে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতার প্রবণতা ক্রমেই কমে যাচ্ছে।”
শেখ হাসিনা বলেন, “বৈশ্বিক পর্যায়ে কিছু অগ্রগতির পরও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত তহবিলগুলোর বিপুল পরিমাণ সম্ভাবনা এখনো পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়ন প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান শর্তসমূহ কঠিন ও জটিল।”
“তবে আমরা শুধু সাহায্যের জন্য বসে নেই। নিজস্ব অর্থায়নে ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠন করে মানুষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার উদ্যোগ নিয়েছি,” জানান প্রধানমন্ত্রী।
সামষ্টিক অর্থনীতি-বিষয়ক অধিবেশন
গত রোববার প্রথম দিনে সামষ্টিক অর্থনীতি-বিষয়ক প্রধান অধিবেশনে সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্যসমূহ দাতাদের সামনে তুলে ধরা হয়।
সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে মূল প্রবন্ধে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম বলেন, “২০১৯-২০ অর্থবছরের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে উন্নীত করা হবে। এ সময়ের মধ্যে নতুন করে ১ কোটি ২৯ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। আর দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসবে। বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২২ থেকে ২৭ শতাংশে উন্নীত করা হবে।”
এ সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনায় যেসব লক্ষ্য রয়েছে, সেগুলো বেশ উচ্চাভিলাষী। এ জন্য দক্ষতার ওপর জোর দিতে হবে। দক্ষতার ওপর জোর না দিলে এসব লক্ষ্য অর্জন বেশ কষ্টসাধ্য হবে।
অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়িয়েই প্রবৃদ্ধি অর্জন করার দিকে সরকার বেশি মনোযোগী বলে অর্থমন্ত্রী জানান। তাঁর মতে, শিল্পায়নের বড় বাধা হলো জমির প্রাপ্যতা। তবে সরকার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন করছে। এতে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
অর্থমন্ত্রীর মতে, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সম্পদ আহরণ বৃদ্ধিতে কর ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। বর্তমানে মাত্র ১১ লাখ ব্যক্তি কর দেন। এটা দ্বিগুণ করার লক্ষ্য রয়েছে।
উন্নয়ন সহযোগীরা যা বলেন
সরকার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, বিশ্বব্যাংকের মার্টিন রামার মতে, এগুলো অর্জন বেশ ‘কঠিন’ হবে। তিনি বলেন, সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগ ৩৪ শতাংশে উন্নীত করা।
এ জন্য শ্রমঘন শিল্প বিনিয়োগ লাগবে। এসব করা না গেলে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা কঠিন হবে। তাঁর মতে, বাজেটের আকার যে হারে বাড়ছে, তা বাস্তবায়নে দক্ষতা সে গতিতে বাড়ছে না।
প্রশ্নোত্তর পর্বে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) আর্টিকেল ফোর মিশনের প্রধান রডরিগো কুবেরা কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির তাগিদ দেন। এর কারণ হিসেবে তিনি মত দেন, ভবিষ্যতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারকে বেশি অর্থের জোগান দিতে হবে। নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আইন শিগগিরই বাস্তবায়ন শুরুর পরামর্শ দেন তিনি।
অন্যদিকে সভার প্রথম দিনে অন্যতম উন্নয়ন-সহযোগী বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান অর্থনীতিবিদ মার্টিন রামা বলেন, “বিশেষ করে দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনা এবং সবার জন্য প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করাটা বাংলাদেশের অন্যতম সাফল্য। যে কারণে বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষা ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের সাফল্য রয়েছে।”
তবে তার মতে, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়ন, বিশেষ করে জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন।
সভায় আর্থিক খাতের সংস্কারের বিষয়গুলো তুলে ধরেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান। তিনি বলেন, “বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও এক দশক ধরে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। এ প্রবৃদ্ধি বাড়াতে দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন তিনি। এগুলো হলো সবুজ অর্থায়ন এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদাভিত্তিক প্রবৃদ্ধি অর্জন।”