ঈদ উৎসব সামনে রেখে বেপরোয়া জাল টাকা তৈরীর চক্রগুলো

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.06.10
BD-fakebill রাজধানীর মিরপুর থেকে ‘জাল নোট চক্রের’ ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যারা ঈদ সামনে রেখে ৫০ লাখ টাকার নোট ‘বাজারে ছাড়ার’ পরিকল্পনা করেছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। ৯ জুন ২০১৫
বেনার নিউজ

জাল টাকা তৈরির প্রায় অধর্শত চক্র ঈদকে সামনে রেখে বিশেষভাবে তৎপর হয়ে উঠেছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ জানিয়েছে, উৎসবের আগে যখন বাজারে ক্রেতা সমাগম বেশি হয় তখনই জাল টাকার সঙ্গে জড়িত চক্রগুলোও বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে।  জাল নোটের চাহিদা তৈরি হলে এর চাহিদা ও উৎপাদনও বেড়ে যায়।  

সর্বশেষ গত ৮ জুন রাজধানী থেকে ধরা পড়া শফিকুল ইসলাম ওরফে শামীমসহ ছয়জনের দলটি মূলত সামনে ঈদকে লক্ষ্য করে জাল মুদ্রা তৈরি করছিলেন। তাঁদের কাছ থেকে প্রায় ৫০ লাখ টাকা মূল্যমানের জাল নোট উদ্ধার করা হয়েছে।

ডিবির উপ কমিশনার (পশ্চিম) শেখ নাজমুল আলম বেনারকে বলেন, সারা বছরই তাদের ব্যবসা চলে। উৎসবে তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় জাল টাকা বন্ধের বিষয়ে দুই দেশের চুক্তি হয়েছে।

ডিবির সহকারী কমিশনার মাহমুদ নাসের বলেন, সীমান্ত জেলাগুলোতে ভারতীয় গরু কেনা-বেচার সময় জাল টাকার ব্যবহার হয়। বিশেষ করে কোরবানীর ঈদের আগে জাল টাকার ব্যবহার ও উৎপাদন বেড়ে যায়।

ডিবি জানায়, জাল নোট তৈরির প্রতি ধাপের জন্য রয়েছে পৃথক লোক। গ্রেফতারকৃতদের  কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মুদ্রা তৈরির সাদা কাগজ থেকে, নিরাপত্তা সুতা সবই কেনা হয় খোলা বাজার থেকে।

আসামীদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, নোট তৈরির প্রথম ধাপ হলো কাগজ তৈরি। বাজার থেকে সাদা কাগজ (এ ফোর মাপের) কিনে এর ওপর স্ক্রিন প্রিন্টে সাদা রঙের ওপর ঝাপসা করে (বঙ্গবন্ধুর ছবি ও ১০০০ হাজার টাকা লেখা) জল ছাপ দেওয়া হয়।

সাদা কাগজের ওপর সাদা রং লাগানোয় কাগজটি আরেকটু ভারী হয়। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দুই বা তিনজন কাজ করেন।

এরপর এর ওপরে ট্রেসিং পেপার বিশেষভাবে আঠা দিয়ে লাগানো হয়। মূল কাগজ আর ট্রেসিং কাগজের মাঝেই জাল নিরাপত্তা সুতা লাগানো হয়।

পুরান ঢাকার চকবাজার থেকে চকচকে মোড়কের কাগজ কিনে এর ওপর প্রিন্ট করিয়ে সরু করে কেটে নিয়ে নিরাপত্তা সুতা তৈরি করা হয়। ট্রেসিং তৈরি ও মূল কাগজের সঙ্গে লাগানোর কাজটি করেন অন্য দুই-তিনজন।

কাগজ প্রস্ত্তত হয়ে গেলে লম্বা পাতা সাধারণ প্রিন্টারে ভরে দুইপাশে প্রিন্ট দেওয়া হয়। প্রিন্টের ডিজাইন ও প্রিন্ট সেটাপ তত্ত্বাবধান করেন আরো একটি দল। তবে প্রিন্টের সময় তদারক করেন দলনেতা নিজে।

একেকটি পাতায় চারটি করে নোট হয়। এরপর ছাপানো নোট মাপমতো কেটে নিয়ে বান্ডিল তৈরি করা হয়।

ডিবির সহকারী কমিশনার মাহমুদ নাসের জনি বেনারকে বলেন, ‘ জাল টাকা তৈরির ৪৫ থেকে ৫০টি চক্র এখনও সক্রিয়। পূর্ণাঙ্গ একেকটি চক্রকে জাল টাকার কারবারীরা বলে, ‘কোম্পানি’’।

একেকটি কোম্পানিতে জাল টাকা তৈরির কাগজ তৈরি থেকে শুরু করে ডিজাইন করা, প্রিন্ট নেওয়া ও বিপণনের লোক থাকে। ১২ থেকে ১৫ জন মিলে একেকটি কোম্পানি হয়।

তিনি বলেন, আবার ছোট কিছু দল আছে যারা শুধুই কাগজ তৈরি করে বেচে দেয়। আরেকটি দল নিরাপত্তা সুতাসহ ট্রেসিং পেপার বিক্রি করে।

আর কয়েকজন আছেন যারা টাকা নিয়ে শুধু কম্পিউটারের ফটোশপ সফটওয়্যার ব্যবহার করে টাকার ডিজাইন ও সেটাপ করে দেন। যাতে প্রিন্ট দেওয়া মাত্র ঠিক সাইজে, আসলের মতো রঙের টাকা বের হবে।

মাহমুদ নাসের বলেন, জল ছাপ সহ এক বান্ডেল কাগজের (এ ফোর সাইজের) দাম চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। আবার নিরাপত্তা সুতাসহ এক বান্ডেল ট্রেসিংয়ের দামও ওরমকম। এক পাতায় চারটি করে নোট তৈরি করা যায়।

আর একবার ডিজাইন করাতে খরচ ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। একবার ডিজাইন করলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা না পড়া পর্যন্ত নোট তৈরি হয়।

নোট তৈরির জন্য কম্পিউটারে সাধারণ কার্টিজ ব্যবহার করা হয়। ২ হাজার ৮০০ টাকার এক সেট (চারটি) কার্টিজে চার থেকে পাঁচ বান্ডেল নোট হয়। এক লাখ টাকার সম পরিমাণ জাল নোটকে বান্ডেল বলা হয়।

মাহমুদ নাসের বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমি যে চক্রগুলো পেয়েছি এর মধ্যে জাকির, আমজাদ, রহিম বাদশা, ইমন, মাহাবুব মোল্লা ও পলাশের কোম্পানি উল্লেখযোগ্য’।

সবাই এর আগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তবে কিছুদিনের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে গেছেন। এখন শুধু আমজাদ কারাগারে রয়েছেন।

জাল টাকা তৈরির পাশাপাশি একটি চক্র জাল রুপিরও ব্যবসা করে। জাল টাকার কারবারীরা এসব রুপিকে বলে আইএস রুপি। প্রফেসর সেলিম ওরফে কানা সেলিম, হুমায়ুন, মোস্তফা, সালমা, সগির মাস্টার, কামাল মাস্টার, মনির, জামান কোম্পানি জাল রুপিরও কারবার করেন।

আইএস রুপি হাতে নিয়ে ধরার কোনো উপায় নেই যে এগুলো জাল। শুধু এর উৎস দেখে এগুলো জাল রুপি হিসেবে শনাক্ত করা হয়।

সহকারী কমিশনার বলেন, ‘সাধারণত গ্রেপ্তারের কয়েকমাসের মধ্যেই কোম্পানি প্রধান বা চক্রের নেতা জামিনে বেরিয়ে আসেন।

আর অন্য যারা থাকেন তাদের বলা হয় “কামলা”। এই কামলারা আরেকটু বেশি দিন কারাগারে থাকেন। চক্রের নেতারা জেল থেকে বেরিয়েই আবার একই পেশায় জড়িয়ে পড়েন।’

ডিবির তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি কোম্পানিতেই দুই থেকে তিনজন ‘ডিস্ট্রিবিউটর’ থাকেন। যাদের কাজ জাল টাকা দ্বিতীয় স্তরে ছড়িয়ে দেওয়া। এক বান্ডেল তৈরি নোট উৎপাদনকারীর কাছ থেকে ১২ থেকে ২০ হাজার টাকায় কিনে নেয় পাইকারেরা।

এরপর সেগুলো প্রায় দ্বিগুণ দামে তাঁরা যাদের কাছে বিক্রি করেন তাদের বলা হয় ‘হাতে কাটা গ্রুপ’। এই গ্রুপের লোকজন খোলা বাজারে নোটগুলো ছাড়েন। দুই থেকে তিনজনের একটি দল খোলা বাজারের ভীড়ের মধ্যে এক হাজার টাকা দিয়ে দুই-তিনশ’ টাকার কেনাকাটা করেন।

দোকানদারের সন্দেহ হলে তাঁদের অন্য দুই সঙ্গী এগিয়ে এসে টাকা নিয়ে নাড়াচাড়া করে সেটিকে আসল হিসেবে রায় দিয়ে দেয়। এরকম ক্ষেত্রে তারা আসল টাকাও বের করে দেয়।

‘ঈদকে সামনে রেখে প্রতি বছরই জাল নোটের বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। বিশেষ করে কোরবানির সময় পশু হাটগুলোত আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক থাকে’, বেনারকে জানান র‍্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান।



মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।