ফেলানীর খুনি বিশেষ আদালতে খালাস,বিচার চলবে সুপ্রিম কোর্টে
2015.07.03

বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে পুনর্বিচারে নির্দোষ ঘোষণা করায় হতাশা প্রকাশ করেছে ফেলানীর পরিবারসহ বাংলাদেশ ও ভারতের মানবাধিকার কর্মীরা। বহুল আলোচিত এই নিষ্ঠুর হত্যা মামলায় গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বিশেষ আদালত অমিয়কে খালাস দেয়।
গত প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশে–বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম এই বিচার প্রত্যাখ্যান করে গতকাল শুক্রবার উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন।
তবে এ বিষয়ে ভারতের সুপ্রিম কোটে একটি পৃথক মামলা চলমান রয়েছে। ২০১৩ সালে ওই মামলা হলেও এত দিন বিএসএফ–এর বিশেষ আদালতে বিচার চলমান থাকায় ওই মামলাটি নিয়ে নড়াচড়া ছিল না।
“ওই মামলার বাদী আমি ও ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম। মামলায় বারবার বিএসএফ সময় নিচ্ছে। আগামী ১৪ জুলাই মামলার তারিখ রয়েছে”, বেনারকে জানান বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী।
মামলায় আইনজীবী নিয়োগের কথা জানিয়ে সালমা আলী বলেন, “আশা করি সেখানে ন্যায় বিচার পাওয়া যাবে”।
ভারতের মানবাধিকার সংস্থা ‘মাসুম’ বিএসএফ–এর এই রায়ের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্ট বা ভারতের সুপ্রিম কোর্টে রিট আবেদন করার ঘোষণা দিয়েছে। মাসুম এর সম্পাদক কিরীটি রায় গতকাল শুক্রবার নয়াদিল্লিতে সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল জানান, ভারতের ওই মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করবে আসক।
“আমাদের রাষ্ট্র ও সরকার কূটনৈতিকভাবে এ ঘটনার পুনর্বিচার দাবি করতে পারে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অসন্তোষ প্রকাশ করে ন্যায়বিচার দাবি করা যেতে পারে,” বেনারকে জানান সুলতানা কামাল।
রায়ের কপি না পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ও বিজিবি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
“এটা একটি বিচারিক প্রক্রিয়া। আমরা এখন পর্যন্ত অফিশিয়ালি কিছু জানি না। বাহিনীর প্রধান সই করার পরই রায় চূড়ান্ত হবে। তখন আমরা বিস্তারিত জানতে পারব,” বেনারকে জানান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ।
মহাপরিচালক বলেন, যদি বিজিবির কিছু করার থাকে তাহলে নিশ্চয়ই করা হবে। এর আগেও ফেলানীর পরিবারকে বিচারের জন্য ভারতে পাঠানোসহ বিভিন্ন সহায়তা করা হয়েছে, ভবিষ্যতেও তা করা হবে।
ফেলানীর বাবা মা হতাশ
অপ্রত্যাশিত এই রায়ে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম ও মা জাহানারা খাতুন। জাহানারা খাতুন সকালে রায় শুনে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি, কেঁদেছেন আর বিলাপ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এ বিচার আল্লায় করব’।
এই রায় মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী উল্লেখ করে কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর আব্রাহাম লিংকন বেনারকে বলেন, “এই রায় ভারতের বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।এর ফলে সীমান্ত হত্যার ক্ষেত্রে বিএসএফ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে”।
তাঁর মতে, ভারত সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারে। পাশাপাশি ফেলানীর বাবা এই রায়ের বিরুদ্ধে ভারতের উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবেন। তবে এ ক্ষেত্রে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সহায়তা প্রয়োজন।
সুলতানা কামাল বলেন, যে বিশেষ আদালত প্রথম রায় দিয়েছিল, সেই আদালতই পুনর্বিচার করেছে। তথ্য প্রমাণ অনুযায়ী অমিয়ের গুলিতেই ফেলানী নিহত হয়। এরপরও তাকে নির্দোষ ঘোষণা করার বিষয়টি দুঃখজনক ও হতাশাজনক।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওই উপদেষ্টা বলেন, “দুই দেশের মধ্যে এখন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। উভয়েই সীমান্তে সংঘাত কমিয়ে আনার বিষয়ে অঙ্গীকার করছে। এ বিষয়ে আন্তরিকতা প্রমাণের জন্য ফেলানী হত্যার বিচার করাটা ভারতের জন্য একটা বড় সুযোগ ছিল”।
বিলম্বিত বিচার প্রক্রিয়া
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ভোরে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্ত দিয়ে ফেরার সময় ভারতের চৌধুরীহাট বিএসএফ ক্যাম্পের অমিয় ঘোষ ১৫ বছরের কিশোরী ফেলানীকে গুলি করে হত্যা করে।
এ ঘটনার দুই বছর পর ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট কোচবিহার জেলার সোনারী এলাকায় ১৮১ বিএসএফ ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্স কোর্টে ফেলানী হত্যার বিচার শুরু হয়। ৬ সেপ্টেম্বর ওই বিচারে বিএসএফ সদস্যকে নির্দোষ ঘোষণা করে রায় দেয়া হয়।
এই রায় প্রত্যাখ্যান করে ফেলানী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ দাবি করে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারের কাছে আবেদন করেন ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটি পুনর্বিচারের সিদ্ধান্ত নেয় বিএসএফ কর্তৃপক্ষ। বাবা নুরুল ইসলাম গত বছরের ১৭ নভেম্বর দ্বিতীয়বারের মতো সাক্ষ্য দেন ভারতের ওই বিশেষ আদালতে। গত ৩০ জুন আদালত শুরু হয়। তিন দিনের মাথায় বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে এ রায় ঘোষণা করা হয়।
কুড়িগ্রামের স্থানীয় একাধিক সাংবাদিক টেলিফোনে বেনারকে জানান, নাগেশ্বরী উপজেলায় ফেলানীর পরিবারে এ খবর পৌঁছার পর মাতম সৃষ্টি হয়। ফেলানী মারা যাওয়ার পর ফেলানীর নামেই নামকরণ হয়েছে নাখারগঞ্জ গ্রাম।
‘আমরা খুশি নই। এভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় বিচার না হলে সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মানবতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে,” জানান বিশ্বজিৎ বর্মা, যিনি ফেলানীর গ্রামের একটি স্কুলের শিক্ষক।
ফেলানীর মামলার সহায়তাকারী আব্রাহাম লিংকন বলেন, “বিএসএফের মতো একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনীর একজন সদস্যের অপকর্মের দায় গোটা বাহিনীই নিয়ে নিল। এই দায় রাষ্ট্র হিসেবে ভারতেরও”।