রানা প্লাজা ট্রাজেডির দুই বছর, প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ দেয়নি আন্তর্জাতিক ক্রেতারা

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.04.23
BD-garments রানা প্লাজার ট্রাজেডিতে আহত শ্রমিক রেহানা খাতুন এবং তার স্বামী খোকন মিয়া। ২২ এপ্রিল,২০১৫
বেনার নিউজ

ছয় মাসের সন্তান সম্ভবা পাবনার রেহানা খাতুন। নতুন অতিথির স্বপ্নে বিভোর থাকলেও নিজের দুটো পা না থাকার বাস্তবতা তার স্বপ্নকে আঘাত করে বারবার। মনে করিয়ে দেয় সেই ভয়ঙ্কর রানা প্লাজা ধসের দুর্ঘটনার কথা।

দুবছর আগের অভিশপ্ত সে ঘটনার দুদিন পর ধ্বংসস্তূপ থেকে রেহানা জীবিত উদ্ধার হলেও এক সপ্তাহের মাথায় কেটে ফেলতে হয়েছিল তার দুটি পা। এখন সাভারের গণকবাড়ির সিআরপির একটি কক্ষে হুইল চেয়ারেই কাটছে রেহানার পুরোটা সময়। তবে তার দুঃখ কিছুটা ভাগ করে নিয়েছেন সিআরপির’ই এক অফিস সহকারী মো. খোকন। পঙ্গু রেহানাকে আটমাস আগে ভালবেসে বিয়ে করেছেন তিনি। মানবিকতা আর ভালবাসার কাছে পঙ্গুত্বের হার হলেও দৈন্যতার কাছে বারবার হেরে যাচ্ছে এই দুই জীবন যোদ্ধা। নিয়মিত মেডিকেল চেক-আপও জোটেনা মা হতে চলা রেহানার।

রানা প্লাজা দূর্ঘটনার আরেক ক্ষতিগ্রস্ত কিশোরী আন্নাকে পাওয়া যায় ঢাকার মহাখালী ক্যান্সার হাসপাতালের একটি বিছানায়। ঘটনার দুদিন পর ডান হাত কেটে উদ্ধার করা হয় ১৩ বছরের আন্নাকে। সম্প্রতি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ায় ডান পা-ও কেটে ফেলতে হয়েছে মেয়েটির।এ ক্যান্সার আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা চিকিৎসকদের।

একসময় বাড়িময় ছুটে বেড়ানো এ কিশোরী বেঁচে থাকলেও তার দিন কাটে মরার মত-বলে কেঁদে ওঠেন তার মা।তিনি বলেন, সরকারি অনুদান হিসেবে পাওয়া মাসে ১২ হাজার টাকায় মেয়ের চিকিৎসা ও সংসার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছি।

সাভারের রানা প্লাজা ট্রাজেডির দুইবছর পরেও আন্না, রেহানাসহ সকল ক্ষতিগ্রস্তরাই এমন দুর্বিসহ দিন কাটাচ্ছেন। তাদের কপালে জোটেনি প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন। আর সামান্য যে অনুদান দেওয়া হয়েছে তার বণ্টনও স্বচ্ছ নয় বলে অভিযোগ ক্ষতিগ্রস্তদের।

ক্ষতিপূরণ আদায় না হওয়ার কারণ হিসেবে ক্রেতা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর অসহযোগিতা, সরকারের সঙ্গে অন্যান্য কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতা, দায়িত্বে অবহেলা, রাজনৈতিক প্রভাব ও স্বচ্ছতার অভাবকে চিহ্নিত করেছে সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে এ দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য গঠিত প্রধানমন্ত্রীর তহবিলের অর্থ বণ্টনে অস্বচ্ছতার অভিযোগ এনেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ(টিআইবি)।এ তহবিলে সংগ্রহকৃত ১২৭ কোটি টাকার মধ্যে ১০৮ কোটি এখনো অব্যবহৃত উল্লেখ করে ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তদের তালিকা ও ক্ষতিপূরণের পরিমাণ প্রকাশ করার দাবি জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।তবে সরকার বলছে ‘রানা প্লাজা’ নামে কোনো তহবিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নেই। তবে প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিল থেকে ২৯ কোটিসহ এপর্যন্ত মোট ১৮৯ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।

এছাড়া রানা প্লাজা ক্ষতিগ্রস্তদের ৫৫ শতাংশ এখনো কর্মহীন, ৬১ শতাংশ চিকিৎসাধীন এবং ৫৯ শতাংশ হতাশা ও মানসিক আঘাত বয়ে বেড়াচ্ছে বলে এক জরিপ প্রতিবেদনে উল্লেখ উন্নয়ন সংস্থা একশনএইড।  

২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসের দুর্ঘটনায়ে একদিনে প্রাণ হারায় এক হাজারেরও বেশি মানুষ। ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ১৮ জন হাসপাতালে মারা যান। এ দুর্ঘটনায় সব মিলে ১ হাজার ১৩৫ জন মারা যান।

প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ দেয়নি ক্রেতারা

এ ঘটনার পর বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বেতন কাঠামো ও পরিবেশ নিয়ে নড়ে বসে পুরো বিশ্ব।হতাহত শ্রমিকদের সাহায্যে ৪০ মিলিয়ন ইউএস ডলারের সংগ্রহের লক্ষ্যে গঠিত হয় ‘রানা প্লাজা ডোনার্স ট্রাস্ট ফান্ড’। পরে সে লক্ষ্য ৩০ মিলিয়নে নামিয়ে আনা হয়। তবে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের অসহযোগিতায় সে লক্ষ্যও পূরণ হয়নি। এখন পর্যন্ত সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ২১.৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার। এর মধ্যে প্রায় ১৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে জানিয়েছে টিআইবি। আন্তর্জাতিক ক্রেতা সংগঠন  এ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্সের চাপেও আদায় হয়নি বাকি অর্থ। টিআইবি বলছে, রানা প্লাজার সঙ্গে সম্পর্কিত ১৪টি রিটেইলার ব্রান্ড এ ফান্ডে সহায়তা দেয়নি। আর ওয়ালমার্ট প্রত্যাশিত সহায়তার চেয়ে ১০ লাখ ডলার কম দিয়েছে।

সরকার ক্ষতিপূরণ বিতরনের বিরাট অঙ্কের হিসাব দেখালেও ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকেই এখনো কোন টাকা পাননি। তাদেরই একজন নাসিমা আক্তার। বর্তমানে রানা প্লাজার ঘটনাস্থলের পাশে আরেকটি গার্মেন্টেসে কর্মরত এই শ্রমিক বলেন, ঘটনার পর ক্ষতিপূরণ, পুর্নবাসনসহ কত প্রতিশ্রুতি শুনেছিলাম। পুর্নবাসন দূরে থাক, কিছুদিন আগে একটি চিঠিতে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে আমি কোন অনুদানও পাব না। এমন চিঠি অনেকেই পেয়েছে। কোন অঙ্গ না হারালেও বিল্ডিং চাপা পড়ায় এখন শরীরে নানা ধরনের যন্ত্রণায় ভুগি। এছাড়া সামান্য শব্দ শুনলেও আঁতকে উঠি। বেশি পরিশ্রমও করতে পারিনা।
এ ঘটনায় এখনো ১৫৯ জন শ্রমিক নিখোঁজ রয়েছে। যে কারণে তাদের পরিবার সহায়তাও পাচ্ছেনা।

নিহত শ্রমিকদের পরিবাররাও প্রতিশ্রুত অর্থ পায়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর সত্যতা মেলে রংপুরের পূর্ব নারায়নপুর গ্রামের নিহত শ্রমিক সোনা মিয়ার বাবা শাহনূর মিয়ার কথায়। টেলিফোনে তিনি বলেন, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিল সোনা। সে চলে যাওয়ার পর ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা শুনেছিলাম। কিন্তু দুই বছরে পেয়েছি মাত্র চার লাখ টাকা।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস এন্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন ক্ষতিপূরনের বিষয়ে বলেন, ‘শ্রমিকদের রক্তের কোনো মূল্য নেই সরকারের কাছে। তাই দুই বছর পার হলেও রানা প্লাজায় হতাহত শ্রমিকদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দেয়নি সরকার। বরং ভয়াবহ শিল্প বিপর্যয়ের চিহৃটুকুও তারা রাখতে চায় না।’

এসব প্রসঙ্গে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল বেনারকে বলেন, ওই ঘটনায় কারো কারো শারীরিক আঘাত না থাকলেও মানসিক আঘাত তীব্র। এরা ক্ষতিগ্রস্তদের বাইরে নয়। ত্রাণ হিসেবে যা এসেছে তা ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।তবে হতাহতদের অনেকেই এখনও ক্ষতিপূরণ পাননি।আর যারা পেয়েছেন তা পর্যাপ্ত নয়।
তিনি বলেন, রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে সংগৃহিত অর্থের মাত্র ১৯ কোটি টাকা বিতরণ হয়েছে। এই অর্থ এসেছিল রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য। তাই পুরোটাই তাদেরই পাওনা।

তবে এ বিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বেনারকে বলেন, এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে শ্রম মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল, আইএলও ট্রাস্ট ফান্ড এবং অন্যান্য বায়ারদের পক্ষ থেকে এ পর‌্যন্ত ১৮৯ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি প্রাইমার্ক দিচ্ছে আরো ১১৩ কোটি টাকা। এরপরেও যদি কোন পরিবার সাহায্য পা্য়নি বলে প্রমাণ নিয়ে আসতে পারে তাহলে তাদের বিষয়টি বিবেচনা করবো।

তিনি টিআইবির অভিযোগ খন্ডন করে বলেন, রানা প্লাজা ক্ষতিগ্রস্তদের প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ২৯ কোটি ৩৯ লক্ষ টাকা বিতরণ হয়েছে। আর এ তহবিলের টাকা শুধু একটি দূর্ঘটনা নয়, দেশের নানা ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য দেওয়া হয়। শুধু ‘রানা প্লাজা’ নামে কোন তহবিল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে নেই।

এদিকে গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজেএমইএ-এর সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার জের আমরা কাটিয়ে উঠেছি। সরকার, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পাশাপাশি বিজিএমইএ-ও সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এদেশে এ ঘটনার কোন পুনরাবৃত্তি আর হবে না। ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি আমাদের সাহায্য এখনো অব্যাহত আছে।
তিনি টিআইবির প্রতিবেদনের সমালোচনা করেন।

ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ উপ-কমিটির সুপারিশ অবাস্তবায়িত

উচ্চ আদালতের নির্দেশে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ উপ-কমিটি গঠন হলেও সে কমিটির সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি। এর পিছনে পোশাক মালিকদের হাত রয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এ কমিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এমএম আকাশ।

তিনি বলেন, পোশাক মালিকদের প্রভাবেই কমিটির দেওয়া সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। বিজেএমইএ অত্যন্ত ক্ষমতাশালী প্রতিপক্ষ। তারা সেদিনের ঘটনাকে অপরাধ মনে না করে নিছক দূর্ঘটনা বলে আখ্যা দেয়। কমিটির ক্ষতিপূরণ বণ্টণের সুপারিশও তারা মেনে নেয়নি।

এ উপ-কমিটি মৃত এবং দুই অঙ্গ হারানো শ্রমিকদের জন্য ১৫ লাখ, এক অঙ্গ হারানোদের ১০ লাখ, দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসারতদেরিএককালীন ছয় লাখ টাকা করে এবং ফ্রি চিকিৎসা সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করে। একইভাবে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য দুই লাখ টাকা করে এবং নিহত এবং আহতদের সন্তানদের এইসএসসি পর্যন্ত শিক্ষার খরচ বহন করার সুপারিশও করে এ কমিটি।

আসামিরা জামিনে

এদিকে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ইতিহাসের ভয়াবহতম এ ভবন ধসের মামলায় গ্রেফতারকৃত ২২ আসামির মধ্যে ভবনটির মালিক সোহেল রানা ও এক গার্মেন্টস মালিক আমিনুল ছাড়া সব আসামিই জামিনে ছাড়া পেয়েছেন।


ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা

এনটিপি এবং আমেরিকান ও ই্‌উরোপীয় ক্রেতা সংগঠন একর্ড ও অ্যালায়েন্স রানা প্লাজা দূর্ঘটনার পর  বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরের কর্মপরিবেশ   পর‌্যবেক্ষণ করছে। তাদের নিয়মিত পরিদর্শনের ফলে বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ ঘটনার পর  ১৪২টি ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন হয়েছে। নিয়োগ হয়েছে ২৩৫ জন নতুন কারখানা পরিদর্শক। এর ফলে একজন পরিদর্শককে আগে যেখানে ৭৭২টি কারখানা পরিদর্শন করতে হত, এখন মাত্র ৭২টি কারখানা পরিদর্শন করতে হবে। এছাড়া গত একবছরে ফায়ার সার্ভিসে ২১৮ জন ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টরও নিয়োগ পেয়েছেন। এসবই পোশাক শিল্পের ইতিবাচক দিক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।