নিহত বাংলাদেশী হাজির প্রকৃত সংখ্যা এখনো মেলেনি, নিখোঁজ ৯৮

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.09.28
BD-haji রোববার বিকেলে ৩০৫ জন হাজিকে নিয়ে সৌদি এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়। ২৭ সেপ্টেম্বর,২০১৫
বেনার নিউজ

সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা নগরীর মিনায় পদপিষ্ট হয়ে এখন পর্যন্ত ১০ জন বাংলাদেশি হাজির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রণালয়। এছাড়া ৯৮ জন নিখোঁজ থাকার কথাও জানানো হয়েছে।

এদিকে নিহত বাংলাদেশি হাজিদের সংখ্যা নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। হজ এজেন্সি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)-এর প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম বাহার সৌদি আরবে বাংলাদেশী হজ মিশনের উদ্বৃতি দিয়ে বলেন,  হজে পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন ১৮জন।

গত বৃহস্পতিবার সকালে পবিত্র হজের শেষ পর্যায়ের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সৌদি আরবের মিনায় হাজিরা 'শয়তানের স্তম্ভে' পাথর ছুড়তে যাওয়ার সময় হুড়োহুড়িতে পড়লে পদদলিত হয়ে বহু হতাহতের দুর্ঘটনা ঘটে। এ পর্যন্ত ৭৬৯ জন নিহত ও ৯৩৪ জন হাজি আহত হয়েছেন বলে গত শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন সৌদি আরবের স্বাস্থ্যমন্ত্রী খালিদ আল ফালিহ।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে ৬৫০ জনের ছবি শনিবার প্রকাশ করেছে সৌদি সরকার। ধীরে ধীরে প্রকাশিত ছবির সংখ্যাও বাড়ছে। সে ছবির মাধ্যমে নিখোঁজ হাজিদের শনাক্ত করার কাজ করছে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ এই দুর্ঘটনায় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।

এদিকে রোববার নিহত বাংলাদেশি হাজিদের মধ্যে দুই জনের পরিচয় নিশ্চিত করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরা হলেন খুলনার মো. শহিদুল ইসলাম ও ঢাকার সাভারের আমিনুর রহমান। তবে এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, আমিনুর রহমানের স্বজনরা ছবি দেখে নিশ্চিত হয়েছেন যে এটি আমিনুরের মৃতদেহ নয়। ওই ব্যক্তির পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে। এর বাইরে পরিবারের পক্ষ থেকে ফিরোজা খানম নামের একজন বাংলাদেশি হাজির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হলেও এ পর্যন্ত প্রকাশিত ছবিগুলোতে ফিরোজা খানমের ছবি পাওয়া যায়নি।


তৎপর সরকার

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এ দুর্ঘটনায় হতাহত ও নিখোঁজ হাজিদের যথাযথ ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তৎপর সরকার। যতক্ষণ পর্যন্ত প্রতিজন হাজির নিরাপত্তা নিশ্চিত না হবে, ততক্ষণ এ তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব ডা. মো. বোরহানউদ্দিন বেনারকে বলেন, “ নিহত হাজিদের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকার নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। এক্ষেত্রে আত্মীয়দের মতামত প্রাধান্য পাবে। তবে সবার আগে জরুরি লাশ শনাক্ত করা। সেই প্রক্রিয়া চলছে।”

এ বিষয়ে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ বেনারকে বলেন, “আমরা মরদেহগুলো দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়ার চেয়ে নিখোঁজদের খুঁজে বের করার উপর গুরুত্ব দিচ্ছি বেশি। পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে কোনো লাশ দাফন করা হবে না বলে সৌদি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। দূতাবাসের মেডিক্যাল টিম বাংলাদেশিদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছে। এছাড়া ঘটনার প্রথম দিকে অনেকেরই আত্মীয় স্বজন ফোন করেছেন, তবে এখন তাদের অনেকেই আর ফোন করছেন না। তারা তাদের স্বজনকে খুঁজে পেয়েছেন বলেই আমরা ধরে নিচ্ছি।”

তবে স্বজনদের মাধ্যমে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এখনো ৯৮ জন হাজি নিখোঁজ আছেন বলে জানান তিনি।


উৎকণ্ঠায় নিখোঁজ হাজিদের পরিবার

এদিকে নিখোঁজ বাংলাদেশি হাজিদের পরিবারের মানুষ চরম উৎকন্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। ফেনী শহরের খাজুরিয়া এলাকার নুরুল হুদা দুলাল নিখোঁজ রয়েছেন মিনায় পদদলিত হওয়ার ঘটনায়। তার সন্তান নাজমুল হুদা নিরব বেনারকেকে বলেন, “বাবার খোঁজ না পেয়ে অত্যন্ত উৎকণ্ঠায় দিন পার করছি। কিন্তু দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেও বাবার কোন খোঁজ মিলছে না। তিনি বেঁচে আছেন কিনা তাও জানিনা। এখন পথ চেয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই”।

স্ত্রী তহুরা রহমানকে নিয়ে হজে গিয়েছিলেন হাজি মো. মুজিবুর রহমান।  দুর্ঘটনার পর থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন। তার বড় ছেলে মোবিনুর রহমান বলেন, “শয়তান স্তম্ভে পাথর নিক্ষেপ করতে যওয়ার পথে আব্বা ফোন করেছিলেন। হঠাৎ মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে তিনি দশ মিনিট পরে ফোন করার কথা বলে লাইন কেটে দেন। এটাই তার সঙ্গে পরিবারের শেষ কথা। দুর্ঘটনাটির পর থেকে বাবা-মায়ের  মোয়াল্লেমের (গাইড) সাহায্যে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করেও কোথাও বাবার সন্ধান পাইনি। মাকে পেয়েছি। তিনি স্থানীয় একটি হাসপাতালে আছেন।”  


‘বাংলাদেশি হাজিদের পরিচয় জানতে কষ্ট হচ্ছে’

হাজিদের পরিচয় জানাতে দেরি হওয়ার কারণ সম্পর্কে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ডা. বোরহান উদ্দিন বলেন, “বাংলাদেশের হাজিরা সৌদি আরবে পৌঁছার পর পরই হজ এজেন্সিগুলো তাদের পাসপোর্ট নিয়ে যায়। হাজিদের হাতে একটি বেল্ট পরিয়ে দেওয়া হয়, যেখানে নাম-পরিচয় থাকে। সাধারণত কিছুদিন পর যাওয়া-আসার পথ বুঝে গেলে অনেক হাজি হাতের বেল্টটিও খুলে ফেলেন। হাতবেল্ট ও পাসপোর্ট না থাকায় বাংলাদেশি হাজিদের পরিচয় জানতে কষ্ট হচ্ছে।”

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলছে, গত ২৫ বছরের মধ্যে সৌদি আরবে হাজিদের হতাহতের ঘটনার মধ্যে এটিই সবচেয়ে ভয়াবহ। এর আগে সবচেয়ে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৯০ সালে মক্কার এক টানেলে। সে সময় পদদলিত হয়ে মারা গিয়েছিলেন ১ হাজার ৪২৬ জন হাজি।


চাপের মুখে সৌদি আরব

এদিকে বিপুলসংখ্যক হাজির মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়েছে সৌদি আরব। এ ঘটনার জন্য দেশটির হজ ব্যবস্থাপনার তীব্র সমালোচনা করে জাতিসংঘের তদন্তের দাবি জানিয়েছে ইরান। তবে সৌদি আরব এসব সমালোচনা নাকচ করে দিয়েছে। এ বিষয়ে ইরানের পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়াসহ বিশ্বের মুসলিম অধ্যুষতি দেশগুলোও সৌদি আরবের সমালোচনায় সরব হয়ে উঠেছে। বিশ্বের সবচেয়ে মুসলমান জনবহুল দেশ ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো বলেছেন, “হজ ব্যবস্থাপনার অবশ্যই উন্নতি হওয়া উচিত যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়”। তবে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত মুখ খোলেনি বাংলাদেশ।

হজের কয়েক দিন আগেও গত ১১ সেপ্টেম্বর মক্কার কাছে ক্রেন ভেঙে শতাধিক হাজি নিহত হন। সে ঘটনাতেও বাংলাদেশি একজন হাজি নিহত ও কয়েকজন আহত হয়েছিলেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।