সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকবে কিনা, শুনানি ২৮ বছর পর

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.02.29
BD-hearing রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তাই এটি বাতিলের দাবিতে নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ সমাবেশ করে এসেছে।
বেনার নিউজ

রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৮৮ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করেছিলেন দেশের ১৫ বিশিষ্ট নাগরিক। গত ২৮ বছরে এঁদের ১০ জনই মারা গেছেন। এই দীর্ঘ সময় পর গতকাল সোমবার শুরু হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্পর্শকাতর ওই মামলার শুনানি।

১৯৮৮ সালের ৫ জুন সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে সংযুক্ত করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, যিনি স্বৈরাচার হিসেবে পরিচিত। তখন সংবিধানে ২ক অনুচ্ছেদ যুক্ত করে বলা হয়, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাবে।

ওই সময় স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির পক্ষে রাষ্ট্রধর্মের ওই বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন দেশের ১৫ জন বরেণ্য ব্যক্তি। তাঁদের মধ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, বিচারপতি কে এম সোবহান, কবি সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, শিল্পী কলিম শরাফী, অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন ও সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ মারা গেছেন।

আবেদনকারীদের মধ্যে জীবিত পাঁচজন হলেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্ত, লেখক বদরুদ্দীন উমর, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

তাঁদের ওই আবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে নানা ধর্মবিশ্বাসের মানুষ বাস করে। এটি সংবিধানের মূল স্তম্ভে বলা হয়েছে। এখানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে অন্যান্য ধর্মকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এটি বাংলাদেশের অভিন্ন জাতীয় চরিত্রের প্রতি ধ্বংসাত্মক।

রিট আবেদনের ২৩ বছর পর ২০১১ সালের ৮ জুন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল দেন। ওই দিনই অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ১৪ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে দুজন ড. এম জহির ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম মারা গেছেন।

বাকি ১২ জন হলেন টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, রফিক-উল হক, এম আমীর-উল ইসলাম, এ এফ হাসান আরিফ, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, আখতার ইমাম, ফিদা এম কামাল, আজমালুল হোসেন কিউসি, আবদুল মতিন খসরু, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন ও আ ফ ম মেজবাহ উদ্দিন।

“সংবিধানের ২ (ক) অনুচ্ছেদটি পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবর্তন হয়ে গেছে। এ জন্য পঞ্চদশ সংশোধনীতে পরিবর্তিত বিধানটির ওপর শুনানি করা হবে। এ বিষয়ে সম্পূরক আবেদন করা হয়েছে,” বেনারকে জানান রিট আবেদনকারী আইনজীবী জগলুল হায়দার আফ্রিক।

তাঁর ওই আবেদনের বলা হয়, রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতির বিধান সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী। পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ের আলোকে ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র সংবিধানে ফিরে এসেছে। আদি সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল হয়েছে। এটির সঙ্গে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম অব্যাহত রাখা হলে তা হবে সাংঘর্ষিক ও পঞ্চম সংশোধনীর মামলার রায়ের পরিপন্থী।

পরে আদালত ২৭ মার্চ শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করেন।বিচারপতি নাঈমা হায়দার, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ গতকাল সোমবার এই দিন ধার্য করেন। আদালতে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড. কামাল হোসেন, পরে আসেন এম আমীর-উল ইসলাম।

“দেশের মানুষ কেউ কখনো সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার উচ্ছেদ চায়নি, রাষ্ট্রধর্মের প্রবর্তনও চায়নি । ক্ষমতাসীন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নিজের স্বার্থে এসব উদ্যোগ নিয়েছিল এবং বলা যায়, দেশের অধিকাংশ মানুষ তা মেনে নিয়েছিল,” বেনারকে জানান বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধূরী।

তিনি বলেন, “তবে সচেতন জনগোষ্ঠী বরাবরই এসব ব্যবস্থাকে বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর বিরোধী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী বলে গণ্য করে এসেছে। তারা বারবার করে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দাবি জানিয়েছে।”

২০১১ সালের ১৫ জুলাই দেশের বিশিষ্ট সাত নাগরিক সালাহউদ্দীন আহমদ, কবীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আনিসুজ্জামান ও কাইয়ূম চৌধুরী ‘তবু কেন রাষ্ট্রধর্ম’ শিরেনামে একটি যৌথ নিবন্ধ প্রকাশ করেন।

এতে বলা হয়, “বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে সকল নাগরিকের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাষ্ট্রধর্মের বিধান বর্জন করতে হবে । মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে হলে রাষ্ট্রধর্মের বিধান বিলোপ করতে হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।