বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রনে কমিশন গঠনের আদেশ আদালতের
2015.07.02

নিয়ন্ত্রনহীন বাড়িভাড়া ঠেকাতে সরকারকে ছয় মাসের মধ্যে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত। এই সংস্থা বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে কথা বলে তাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি এলাকাভেদে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ ভাড়া নির্ধারণ করবে। আবাসন ব্যবস্থায় শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্রকে আইনী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
পাঁচ বছর আগে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের করা এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে বুধবার এ আদেশ দেয় আদালত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আদালতের এ রায় দেশব্যাপী বাড়িভাড়ার অনিয়ম কিছুটা হলেও কমিয়ে আনবে।
রায়ে আইন মন্ত্রণালয়ের মনোনীত একজন আইনজ্ঞকে প্রধান করে সাত সদস্যের কমিশন গঠন করতে মন্ত্রী পরিষদ সচিবকে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। এ ছাড়া কমিশনে গৃহায়ন, নগর উন্নয়ন ও পরিকল্পনা বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক, একজন অর্থনীতিবিদ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয় মনোনীত একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি, ভোক্তা অধিকার বা বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত কাজ বা গবেষণা করে বা বেসরকারি সংস্থার একজন প্রতিনিধি, স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয় মনোনীত যেকোনো সিটি করপোরেশনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা কমিশনে থাকবেন।
আদালতের রায়ে বলা হয়, কমিশন আইনের সংস্কার প্রস্তাব, বাড়ির মালিক, আইনজ্ঞ, বিভিন্ন বিভাগ, ভোক্তা অধিকার সংশ্লিষ্ট সহ সকল পক্ষের সঙ্গে কথা বলবে, প্রয়োজনে গণশুনানি করবে, তাদের মতামত ও যুক্তি গ্রহণ করবে, রাজধানীসহ অন্যান্য মহানগর ও শহর অঞ্চলে সর্বোচ্চ ও সর্বনিন্ম বাড়িভাড়া নির্ধারণের প্রস্তাব দেবে। পাশাপাশি দেশের ভাড়াটিয়া ও মালিকের সমস্যা চিহ্নিত করে তার প্রতিকারে স্বয়ংসম্পূর্ন আইনি কাঠামো প্রনয়নে সুপারিশ করবে। কমিশনের প্রস্তাব অনুসারে সরকার বিদ্যমান বাড়িভাড়া আইন সংস্কারেরও উদ্যোগ নেবে বলেও রায়ে আশা প্রকাশ করা হয়।
উক্ত কমিশনের সুপারিশ আইনি কাঠামোয় রূপ না পাওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান ১৯৯১ সালের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী প্রতিটি ওয়ার্ডে বিশেষ করে ঢাকায় বাড়িভাড়া সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একজন করে নিয়ন্ত্রক (আর্থিক সক্ষমতা সাপেক্ষে) নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলে আদালত। এছাড়া ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে বাড়ির মালিকদের বিরোধ হলে এবং বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভাড়াটিয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
রিট আবেদনকারীর আইনজীবী মনজিল মোরশেদ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “রায়ে খুবই খুশি হয়েছি। বাড়িভাড়া নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য মানুষ দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছিল। এ রায়ের ফলে ভবিষ্যতে এ ধরনের বিরোধ শতকরা আশি ভাগ কমে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।”
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বেনারকে বলেন, বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রে দেশে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা আছে। নতুন এই উদ্যোগ সেখানে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে।
তিনি বলেন, “এ ধরনের একটি কমিশনের পর্যবেক্ষণ থাকলে মধ্যবিত্তের আয় এবং ব্যয় অনুমেয় থাকবে। তবে সুশাসনের একটা জায়গা তারপরেও থাকবে। কমিশনটা ঠিক মত তদারক করছে কিনা বা তার বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা সে চ্যালেঞ্জ থাকবে। অর্থাৎ এ ধরনের কমিশন বাস্তবায়নটাও সহজসাধ্য নয়।”
এই গবেষক আরো বলেন, “বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রে চাহিদা এবং সরবারহের উপরেও বাড়ির ভাড়া নির্ভর করে। অর্থাৎ শহরে চাহিদা অনুযায়ী বাড়ি না থাকলে বাড়ি ভাড়া বেড়ে যায়।”
নিয়ন্ত্রহীন বাড়িভাড়া
আইন থাকলেও তদারকি না থাকার সুযোগে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে বাড়ি ও ফ্ল্যাট মালিকরা ইচ্ছামত বাড়িভাড়া বাড়াচ্ছে। কোথাও বছরে একবার, কোথাও দুইবার, আবার কোথাও তিনবারও বৃদ্ধি করা হচ্ছে। অথচ বাড়িভাড়া আইনে স্পষ্ট বলা আছে- ভাড়াটিয়ার সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে দুই বছর পরপর মাত্র ১৫ শতাংশ বাড়িভাড়া বৃদ্ধি করা যাবে। কিন্তু এ আইনের তোয়াক্কা করে না বাড়ির মালিকরা।
জানা গেছে, সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত গুলশান এলাকার প্রতি বর্গফুট বাড়িভাড়া ১৫ থেকে ১৮, বনানীতে ১৪ থেকে ১৬, মহাখালীতে ১১ থেকে ১২, নাখালপাড়ায় ৬ থেকে ৭, কল্যাণপুর-পল্লবীতে ৬, উত্তরাতে ৫ থেকে ৯, শান্তিবাগে ৫ থেকে ৬, নয়াপল্টনে ৯, শান্তিনগরে ৮ থেকে ৯, ঝিগাতলায় ৮ ও ধানমণ্ডিতে ১১.২৫ টাকা। কিন্তু বাড়ির মালিকরা এর চেয়ে আট থেকে দশ গুন বেশি আদায় করে থাকে।
ধানমণ্ডি এলাকায় প্রতি বর্গফুট বাড়িভাড়া ১১ দশমিক ২৫ টাকা হলেও নেওয়া হচ্ছে ৩৩ থেকে ৬০ টাকা হারে। মোহাম্মদপুরে প্রতি বর্গফুটের জন্য ৭ দশমিক ৫০ টাকার স্থলে নেওয়া হচ্ছে ৩০-৪০ টাকা এবং মিরপুরে প্রতি বর্গফুটের ভাড়া ৫ টাকার জায়গায় নেওয়া হচ্ছে ২০-৩০ টাকা অথবা এরচেয়েও বেশি।
তবে আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, বাড়িভাড়া বাড়ানোর কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম না থাকায় ভাড়াটিয়া ও বাড়ির মালিকদের মধ্যে অধিকাংশ বিরোধ সৃষ্টি হয়।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বাড়িভাড়া বেড়েছে গড়ে ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
আর আদালতে এই রিট আবেদন হওয়ার আগে ২০০৫ সালে ৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ২০০৬ সালে ১৪ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং ২০০৭ সালে ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশ বাড়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাড়িভাড়া।
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের রিট আবেদনে বলা হয়, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে ভাড়ার রশিদ, বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেওয়াসহ বিভিন্ন বিধান রয়েছে। কিন্তু অনেক বাড়িওয়ালা আইন ভেঙে ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ান, যখন-তখন বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেন। তারা ভাড়াটেদের বাড়ি ভাড়ার রশিদ দেন না।
ওই আবেদনের প্রাথমিক শুনানি করে ২০১০ সালের ১৭ মে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইন ও বিধি-বিধান কার্যকর করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে হাই কোর্ট।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয়ের সচিব, আইন সচিব ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ সংশ্লিষ্টদের এর জবাব দিতে বলা হয়। ওই রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ৯ মে রায় অপেক্ষমান রাখা হয়। দীর্ঘ অপেক্ষার পর গত বুধবার আদালত এ রায় দেয়।
প্রয়োজন স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষ
রায়ে বলা হয়, ভাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রনের সঙ্গে জটিল অর্থনীতি, সামাজিক ও আইনি বিষয় জড়িত। একটি বহুমাত্রিক ব্যাপক এবং স্বয়ংসম্পূর্ন আইন কাঠামো প্রনয়ণে স্বতন্ত্র সরকারি ভাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এমন কর্তৃপক্ষ সময় সময়ে আবাসন ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, বাড়ির মালিক, ভাড়াটিয়া ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে মানসম্মত, ফেয়ার ও পরিমিত ভাড়া নির্ধারণ করতে পারবে।একটি মডেল ভাড়া চুক্তি প্রনয়ন করবে।
উচ্চ আদালত বলছে, জনগণের জীবন মানের উন্নয়নে অন্যান্য মৌলিক উপকরণের মত উপযুক্ত আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। সেখানে আবাসন ব্যবস্থাকে একটি অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় ছেড়ে না দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।