কর্মজীবী নারীদের আবাসন সংকট‏ বাড়ছে

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.02.23
BD-housing কর্মজীবি নারীদের ঢাকায় আবাসন সংকটের কারণে এক ঘরে ১১ জন পর্যন্ত গাদাগাদি করে ঘুমাতে হয়। জুন,২০০৯
অনলাইন

সান্তা শবনব (ছদ্মনাম)। বিশ্ববিদ্যালয় পর্ব শেষ না হতেই তার ছাত্রী হলের জীবন সাঙ্গ হল। নিজের যোগ্যতায় চাকুরি যোগ হলেও রাজধানী ঢাকায় সান্তা পাচ্ছিল না মাথা গোজার ঠাঁই। ‘একা মেয়ে’ বলে বাসা ভাড়া পাওয়ার যায় না, আর যেগুলো মেলে তারও আকাশচুম্বি ভাড়া। বারবার আবেদন করলেও সাড়া মেলেনি সরকারি কর্মজীবী হোস্টেলে। তবে শেষমেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের ফোনের সুবাদে চাকরির চেয়ে সোনার হরিণ হোস্টেলের সিটটি মিলে যায়। এখন সেখানেই আছেন সান্তা। তবে এই থাকার মেয়াদও শেষ হতে চলল। কারণ, একজন সর্বোচ্চ পাঁচ বছর এখানে থাকার সুযোগ পান।

সান্তার মত হাজার হাজার কর্মজীবী নারী রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে ‘আবাসন সংকট’ নামক বাস্তবতায় ভুগছেন। দিন দিন এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করলেও কর্মজীবী নারীদের আবাসন সংকট নিরসনে সরকারের দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ নেই। বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়ে বিষয়টি দু’একবার আলোচনায় আসলেও সময়ের তালে তা তলিয়ে যায়।

নারী নেত্রীরা বলছেন, বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে অন্যতম বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই আবাসন সংকট। নারীর ক্ষমতায়ন ইস্যু নিয়ে সরকার সরব হলেও বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। এই আবাসন সংকটই তার প্রমাণ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারাদেশেই প্রতিদিন কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে তাদের আবাসনের সমস্যা মেটাতে সরকারি হোস্টেল থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। আবার এসব হোস্টেলে ভর্তির সময়ও পোহাতে হয় নানা ঝক্কি ঝামেলা।  লাগে রাজনৈতিক প্রভাব বা উচ্চ পদস্থদের সুপারিশ। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে হোস্টেল কর্তৃপক্ষ। আর সরকার বলছে, সারা দেশে আরো কর্মজীবী নারীদের জন্য হোস্টেল নির্মানের পরিকল্পনা রয়েছে।

একমাত্র আবাসিক সমস্যার কারণে উচ্চপদের চাকুরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন অনেক নারীই। নুসরাত হায়দার ইমা তাদের মতই একজন। একসময়ে ঢাকাতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করলেও নিরাপদ থাকার জায়গার অভাবে তিনি এখন নিজের এলাকায় গিয়ে একটি স্কুলে পড়ান।

ইমা বেনারকে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে বুঝলাম এই শহরে একটু মাথা গোঁজার ঠাইয়ের জন্যই সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ করতে হয়। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিজের পছন্দমত চাকরি পেলেও ভাল থাকার জায়গা পাইনি। হোস্টেলগুলো বেশি আদায় করলেও সেখানকার নোংরা পরিবেশে বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম। আবার একা মেয়ে বলে বাসা ভাড়া পাওয়াও যায় না। তাই বাধ্য হয়ে প্রায় অর্ধেক বেতনে নিজের শহর ফেনীতে চলে এসেছি। এখন নিজের বাড়িতেই থাকছি।’


সরকারি হোস্টেল মাত্র ৭টি

এদিকে কোনো দপ্তরেই ঢাকা শহর কিংবা দেশের কর্মজীবী নারীর কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে এই সংখ্যা লক্ষ লক্ষ। আর এর বিপরীতে সারাদেশে সরকারি কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের সংখ্যা মাত্র ৭টি বলে জানায় মহিলা অধিদপ্তর। এর মধ্যে  ঢাকার নীলক্ষেত, মিরপুর ও খিলগাঁওয়ে তিনটি এবং বিভাগীয় শহর যশোর, খুলনা,  রাজশাহী ও চট্টগ্রামে একটি করে হোস্টেল রয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৫০৩টি আসন রয়েছে নীলক্ষেত কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে। যার মধ্যে ৪৯১টি আসন সাধারণের এবং ১২টি অতিথি আসন।

মিরপুরের নওয়াব ফয়জুন্নেসা কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে ১৫৪টি আসন রয়েছে। খিলগাঁও বেগম রোকেয়া কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে ২১০টি আসন। যার মধ্যে ২০০টি সাধারণের এবং ১০টি অতিথি আসন। চট্টগ্রামের কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের আসন সংখ্যা ২১৫টি। খুলনা কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের রয়েছে ১৫০টি আসন। রাজশাহী কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে মোট ১১২টি আসন রয়েছে। যশোরের কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের আসন সংখ্যা মাত্র ৪৫। এসব আসনের বিপরীতে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা কয়েক হাজার গুণ বেশি।

এসব হোস্টেলের খাবারের মান ও থাকার পরিবেশ নিয়েও বোর্ডারদের নানা অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে নীলক্ষেত কর্মজীবী নারী হোস্টেলের বোর্ডার সান্তা বলেন, খাওয়ার পানি সমস্যা, খাবার নিম্ন মান আমাদের নিত্য সঙ্গী। তবে হোস্টেল সুপার সাদেকুনে এ অভিযোগ খন্ডন করে বলেন, যেহেতু ন্যূনতম মূল্যে খাবার দিতে হয়, তার মধ্যেই মানসম্পন্ন খাবার দেওয়ার চেষ্টা করে থাকি আমরা।’

এদিকে সরেজমিনে ফার্মগেইট এলাকার নিবেদিকা ছাত্রী হোস্টেলের একটি বিল্ডিংয়ে ঢুকতেই নাকে আসা গন্ধ বলে দেয় কতটা অপরিচ্ছন্ন সেখানকার পরিবশে।  ৫ তলা ভবনটিতে প্রায় ৮০-৮৫ জন নারী বোর্ডার থাকেন। ঘিঞ্জি পরিবেশের হার্ডবোর্ডের তৈরি ছোট ছোট খোপ তৈরি করে সেগুলোকে রুম হিসেবে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। অস্বাস্থ্যকর ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের সঙ্গেঅত্যন্ত নিম্ন মানের খাবারই হোস্টেলটির বৈশিষ্ট্য।


‘প্রতিটি জেলায় জেলায় নারী হোস্টেল হবে’

নিরাপদ আবাসনের জন্য কর্মজীবী নারীদের এই প্রতিনিয়ত লড়াইয়ের কথা স্বীকার করেছেন খোদ  সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি।

তিনি বেনারকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বসহকারে ভাবার সময় এসেছে। বর্তমান সরকার নারীর ক্ষমতায়নে অত্যধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। সেই মোতাবেক কর্মজীবী নারীদের এই আবাসন সংকট নিরসনে দেশের প্রতি জেলায় মহিলা হোস্টেল নির্মানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পর্যায়ক্রমে প্রয়োজন অনুযায়ী উপজেলা পর্যায়েও কর্মজীবি মহিলা হোস্টেল নির্মাণ করা হবে’।


‘কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে’

নারী নেত্রীরা বলছেন, গত কয়েক  নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে কয়েক ধাপ এগিয়েছে। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা আর ধর্মীয় গোঁড়ামি ডিঙিয়ে রাজনীতি, প্রশাসন, ব্যবসা-সব ক্ষেত্রেই নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। কিন্তু এখনো তাদের পথ মসৃন করতে যথাযথ উদ্যোগ নিতে পারেনি সরকার।

এ বিষয়ে কর্মজীবী নারী সংগঠনের সংগঠক জাসদ নেত্রী শিরিন আখতার বেনারকে বলেন, ‘নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। তবে  সরকারকে তাদের এগিয়ে যাওয়া পথ তৈরি করতে হবে। অথচ নারী ইস্যুতে  অবহেলার কারণে সে কাজে অত্যন্ত ধীরগতি দেখা যায়। নারীদের অগ্রগতিতে শুধু সিদ্ধান্ত নিলেই হবে না। সে সিদ্ধান্ত কার্যকর করার ক্ষেত্রে আরো বেশি কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। নারীদেরকেও এসব বিষয়ে আরো বেশি দরকষাকষি করতে হবে।’

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।