৫৭ ধারা বাদ যাচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তার নতুন আইন হচ্ছে

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.01.11
BD-ict সাংবাদিক প্রবীর শিকদারকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং ওই ঘটনার পর থেকে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ এটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে।
বেনার নিউজ

ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে পরিচালিত সব ধরনের অবৈধ কার্যক্রম আইনের আওতায় আনতে সরকার ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন-২০১৬ (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) করতে যাচ্ছে, যার সর্বোচ্চ শাস্তি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা লঙ্ঘন সংক্রান্ত অপরাধের জন্য ১৪ বছরের কারাদণ্ড।

নতুন ওই আইন প্রণয়নের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি আইন থেকে সমালোচিত ও বিতর্কিত ৫৭ ধারাসহ চারটি ধারা বাদ দেওয়া হচ্ছে, যা বাক্‌স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের অন্তরায় বলে আইনজ্ঞরা মত দিয়ে আসছিলেন।

সাংবাদিক প্রবীর শিকদারকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ওই ধারায় গ্রেপ্তার করা হয় এবং ওই ঘটনার পর থেকে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ এটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে।

তবে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ওই ধারাটি বাতিল করা হলেও প্রস্তাবিত ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে নতুন কোনো বিতর্কিত ধারা ঢুকে পড়বে কিনা, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন কয়েকজন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। তাঁরা ডিজিটাল সিকিউরিটি বিষয়ে নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তার কথা বললেও যে প্রক্রিয়ায় এটা প্রণয়ন হচ্ছে, তার সঙ্গে একমত নন।

“আজকের যুগে মানুষ না চাইলেও ডিজিটাল জগতে ঢুকে পড়ছে। এর সুফলও পাচ্ছে। কিন্তু তার নিরাপত্তা দুর্বল হচ্ছে। যেমন, ব্যাংকে টাকা লেনদেন করতে গিয়ে তার গোপনীয়তা ঝুঁকিতে পড়ছে। মুঠোফোনে কথা বলতে গিয়ে তাঁর গোপনীয়তা অনেক ক্ষেত্রেই থাকছে না,” বেনারকে জানান ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

ওই আইনজীবী বলেন, বইয়ে লিখলে একরকম সাজা, আর অনলাইনে লিখলে একরকম সাজা—এটা হতে পারে না। মাধ্যম পরিবর্তনের জন্য শাস্তির মাত্রা বাড়া বা কমার বিষয়টি বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে, যা সংবিধান সমর্থন করে না।  

অবশ্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের পেনাল কোডে যেসব অপরাধ হয়, ডিজিটাল মাধ্যমেও সেসব ধরনের অপরাধ করা যায়।”

তাঁর মতে, সাইবার ক্রাইম হত্যা ও ধর্ষণের চেয়েও কম মারাত্মক অপরাধ নয়। সেটাকে গুরুতর অপরাধ বিবেচনা করে তার শাস্তির ব্যবস্থা প্রস্তাবিত নতুন আইনে রয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিশ্ব পরিস্থিতি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে সাইবার ক্রাইমই সবচেয়ে বড় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।

আইনের খসড়ায় সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছর রাখা হলেও অপরাধ বিবেচনায় সর্বনিম্ন সাজাও রাখা হয়েছে। তবে সর্বনিম্ন সাজা এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। এ ছাড়া খসড়ায় ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে শাস্তির ব্যবস্থা থাকছে।

“আইনটি এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে, মুখের কথার জন্য কাউকে শারীরিক শাস্তির শিকার না হতে হয়। তবে মুখের কথায় কারও মানহানি হলে, কারও বিরুদ্ধে কুৎসা রটালে বা মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করলে মানহানির মামলা বা আর্থিক ক্ষতিপূরণের বিধান থাকতে পারে,” বেনারকে জানান তথ্যপ্রযুক্তি আইনে বিশেষজ্ঞ তানজীব–উল আলম।


৫৭ সহ চারটি ধারা বাদ

৫৭ ধারা ছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৪, ৫৫ ও ৫৬ ধারা বাতিল করতে যাচ্ছে সরকার। এসব ধারা বাদ দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি আইন থেকে ডিজিটাল সংক্রান্ত বিষয়গুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের নাম পরিবর্তনসহ বেশ কিছু ধারায় সংশোধনী আনা হবে।

তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।’

এই ধারায় অপরাধের শাস্তি ছিল সর্বোচ্চ ১৪ ও সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড।

“আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় সাতটি বড় ধরনের অস্পষ্টতা লক্ষ্য করা যায়। এগুলো হলো; মিথ্যা ও অশ্লীল, নীতিভ্রষ্টতা, মানহানি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি,” জানান জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিচালক নূর খানের বরাত দিয়ে ডয়চে ভেলে গত বছরের ২৫ আগস্ট জানায়, আসক-এর কাছে ১১ জনের তথ্য রয়েছে, যাঁরা এই আইনের অপব্যবহারের শিকার হয়ে কারাগারে আটক আছেন। তবে গতকাল রবিবার নূর খান জানান, এ বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য তাঁর কাছে নেই।

২০০৬ সালে প্রণীত তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০১৩ সালে সংশোধন করা হয়। এর ৫৭ ধারাটির অপব্যবহার ও প্রয়োগে স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়ে উঠেছে। আইনজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞরা এটাকে অসাংবিধানিক অভিহিত করে তা সংশোধনের দাবি তোলেন। সংবাদপত্রের প্রকাশক, মালিক ও সম্পাদকদের সংগঠন বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদ এবং বাংলাদেশ নিউজপেপারস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। তখন আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, “সরকার বাক্‌স্বাধীনতার পক্ষে। যেহেতু ধারাটি নিয়ে কথা উঠেছে, সেহেতু এটি পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে।”


তিনটি রিট আবেদন

তিনজন আইনজীবী ৫৭ ধারা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছেন। গত বছরের ২৬ আগস্ট এ আইনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে জামিনে থাকা জাকির হোসেনের পক্ষে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট আবেদন দায়ের করেন আইনজীবী শিশির মো. মনির । মামলাটি খারিজ হয়ে যায়।

এ ছাড়া এই আইনের ৫৭ ও ৮৬ ধারা বাতিল চেয়ে আইনজীবী ইউনূস আলী আকন্দ আরেকটি  রিট আবেদন করেন, যা ৩০ আগস্ট হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে খারিজ করে দেন।

তবে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার একটি রিট নিয়ে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন-২০০৬ এর (সংশোধনী ২০১৩) ৫৭ ধারাকে কেন সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। এটি শুনানীর অপেক্ষায় রয়েছে।


ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

তথ্যপ্রযুক্তি-সংক্রান্ত বিষয়, সাইবার নিরাপত্তা, ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং এ-সংক্রান্ত অপরাধের শাস্তির বিষয়ে নতুন আইন প্রণয়নের কাজ শুরু হয় মাস ছয়েক আগে। প্রথমে সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০১৫ নাম দেওয়া হলেও সামগ্রিকতা বিবেচনায় এটি ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন নামকরণ করা হয়।

গত রোববার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়াটি নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয়ের বৈঠক হয়। আইনটির উদ্যোক্তা আইসিটি মন্ত্রণালয় এবং এটা ছিল খসড়ার ওপর প্রথম বৈঠক।

“অনলাইনে একটি অপরাধ হলে তার প্রভাব অনেক বেশি, প্রচারও বেশি। অফলাইনে সেটা কম। অনলাইনের অপরাধ রোধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি করা হচ্ছে,” সাংবাদিকদের জানান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।

তাঁর মতে, এখন একটি রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য অ্যাটম বোমা হামলার প্রয়োজন নেই। সাইবার আক্রমণ করে একটি রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিকভাবে এবং প্রশাসনিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা যায়।

আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩টি ধারা যাচাই-বাছাই করেছে মন্ত্রণালয়। কিছু বিষয় ছাড়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় যে খসড়া প্রস্তুত করেছে, তাতে ওই মন্ত্রণালয় সমর্থন দিয়েছে।

“ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হওয়ার আগে এটি নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা, জনমত সৃষ্টিসহ বিভিন্ন উদ্যোগ দরকার ছিল। হঠাৎ করে এটি যেন চাপিয়ে দেওয়া না হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা সুরক্ষার নামে যেন বাড়তি সমস্যা সৃষ্টি না করা হয়” জানান জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।